০১:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

করোনায় ছাড় দিতে গিয়ে খারাপ অবস্থায় ব্যাংক খাত

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১০:৩৪:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১
  • / ৪১৩২ বার দেখা হয়েছে

করোনার কারণে কিস্তি পরিশোধ না করলেও ২০২০ সালে কাউকে ঋণখেলাপি করা হয়নি। উল্টো ব্যবসা সচল রাখতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার আওতায় কম সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। আর যারা ঋণ পরিশোধ করেননি, তাদের মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকলেও ইচ্ছা করেই অনেকে ব্যাংকের টাকা দেননি। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমেছে। খারাপ অবস্থায় পড়েছে ব্যাংক ব্যাংক। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির আনুষ্ঠানিক কোনো সংজ্ঞা নেই। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকার পরও যারা দেন না, তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইচ্ছাকৃত এসব খেলাপির বেশিরভাগই এক খাতের নামে ঋণ নিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সক্ষমতা যাচাই না করে প্রভাবশালীদের সহায়তায় ঋণ পেয়ে যান। এভাবে নেওয়া ঋণ বিদেশে পাচার বা বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িতে বিনিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত থাকেন। কৃত্রিম সংকটের বৈধতা পেতে কখনও ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনের পথ বেছে নেন। প্রতিবারই গ্রেস পিরিয়ড (কিস্তি পরিশোধ না করার সময়) নিয়ে ঋণ পরিশোধে বিরত থাকেন। গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে নতুন অজুহাত দাঁড় করান। ঘুরেফিরে তারা আবার আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করা থেকে বিরত থাকেন।

করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে ২০২০ সালে কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর গত ১৯ মার্চের এক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রথমে জুন পর্যন্ত বিশেষ এ ছাড় দেওয়া হয়। পরে দুই দফায় তিন মাস করে সময় বাড়িয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। ব্যাংকের টাকা দিতে চান না- এরকম একটি পক্ষ এই সুযোগ আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল। তবে ঢালাওভাবে আর সুযোগ না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ২৭ জানুয়ারির ব্যাংকার্স সভায় এমডিরা বলেন, বিশেষ ছাড়ের কারণে ইচ্ছে করে ঋণ পরিশোধ না করার একটি পক্ষ গড়ে উঠছে। এ প্রেক্ষাপটে নতুন করে আর সময় বাড়ানো হয়নি। যদিও ব্যবসায়ীদের কিস্তিপ্রতি ঋণের চাপ কমাতে শুধু মেয়াদি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও দুই বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।

বেসরকারি খাতের এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ব্যবসা ভালো থাকলেও ঋণ পরিশোধ না করার জন্য সব সময় একটি পক্ষ সুযোগ খোঁজে। তারা কখনও ঋণ পুনঃতফসিল চান বা পুনর্গঠন চান, কখনও আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। করোনার কারণে এবার যখন ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি হবেন না জানতে পেরেছেন, তখন ইচ্ছা করেই অনেকে ব্যাংকের টাকা দেননি। এই অর্থ তারা হয়তো অন্য কাজে খাটিয়েছেন। এর বাইরে করোনার আগেই বিপুল পরিমাণের অর্থ দীর্ঘ মেয়াদে পুনঃতফসিল করে দেওয়া হয়। তখন সুদহারও কমিয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে কিস্তির পরিমাণ কমে ঋণ আদায়ের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা এখন করোনার দোহাই দিয়ে বিশেষ সুবিধার মেয়াদ আরও বাড়াতে চাইছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকার ঋণ স্থিতির মধ্যে ডেফারেল সুবিধার আওতায় ছিল দুই লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই লাখ ১৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে কোনো কিস্তি পরিশোধ হয়নি। আর ৩৬ হাজার ৭১১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে কিছু কিস্তি পরিশোধ হয়েছে। অবশ্য ডেফারেল সুবিধা পাওয়া বিপুল অঙ্কের এই ঋণ গত বছরই পরিশোধ হওয়ার কথা ছিল- এমনটি নয়। তবে অধিকাংশই পরিশোধ না করায় ঋণ আদায় ব্যাপক কমেছে। গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু ছয় মাসে আদায় কমেছে ৮১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে নিয়মিত গ্রাহকদের থেকে আদায় ৭৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা কমে দুই লাখ ৬০ হাজার ৯০১ কোটি টাকায় নেমেছে। আর ঋণখেলাপিদের থেকে আদায় ব্যাপকভাবে কমে দুই হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে যেখানে নয় হাজার ২৬৩ কোটি টাকা আদায় ছিল। অক্টোবর-ডিসেম্বরের ঋণ আদায়ের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। শেষ তিন মাসেও আদায় অনেক কম হবে বলে জানান ব্যাংকাররা। ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধার কারণে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা কমে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় নেমেছে। মোট ঋণের যা মাত্র ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যত সমস্যাই হোক, যারা টাকা দেওয়ার দিয়ে দেন। যারা দিতে চান না তারা নানা ছুতো খোঁজেন। ইচ্ছাকৃত এসব ঋণখেলাপিকে বারবার সুবিধা দিলে অন্যরা বেকায়দায় পড়েন। ফলে ডেফারেল সুবিধার মেয়াদ না বাড়ানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। যত দাবিই আসুক, আগামীতে এটি আর বাড়ানো ঠিক হবে না। এতে ঋণ পরিশোধ না করার নতুন একটি গ্রুপ তৈরি হবে। তবে প্রকৃত সমস্যা বিবেচনায় কেস টু কেস ভিত্তিতে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।

মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিউল আজম সম্প্রতি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুবিধার কারণে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা থাকলেও অনেকে টাকা দেননি। করোনার কারণে ট্যুরিজম, ট্রাভেলস, কমিউনিটি সেন্টারসহ কিছু খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দৃশ্যমানভাবে দেশে বিক্রি এবং রপ্তানি থেকে আয় আসছে। অথচ করোনার দোহাই দিয়ে টাকা পরিশোধ করছেন না, এমন ঋণগ্রহীতা অনেক। যে কারণে ব্যাংকাররা মনে করেন, ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়া ঠিক নয়। এ ধরনের সুবিধা কেস টু কেস ভিত্তিতে দিলে ভালো হয়।
সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ক্রিসেন্ট লেদার, অ্যাননটেক্স, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হলমার্ক, মিশম্যাপ, এসএ গ্রুপ, আনন্দ শিপইয়ার্ড, ইলিয়াস ব্রাদার্স, কম্পিউটার সোর্সসহ বেশিরভাগ বড় ঋণখেলাপিই ইচ্ছাকৃত বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের অনেকেই টাকা নিয়ে বিদেশে পালানোর পর অর্থ পাচারের মামলা করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কেউ কেউ আবার হেলিপ্যাডসহ দেশে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যদিও এসব খেলাপির দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হতে দেখা যায়নি। মাঝেমধ্যে সরকার সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা দিয়ে থাকে। গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী। গত অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা তিন লাখ ৩৫ হাজার বলে জানান তিনি।
কয়েকটি ব্যাংকের এমডি এবং শাখা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণ পরিশোধ যারা করছেন না, তাদের বেশিরভাগই পুরোনো খেলাপি। তাদের অনেকেই বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন কিংবা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নিয়মিত দেখিয়ে আসছেন। করোনার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই ঋণ শোধ করেননি। আর আগে থেকে যারা নিয়মিত ঋণ ফেরত দিতেন, তাদের অনেকেই নিজ থেকে যোগাযোগ করে টাকা দিয়েছেন। নিয়মিত পরিশোধকারীদের একটি বড় অংশ এপ্রিল ও মে মাসের লকডাউনে বন্ধের মধ্যে টাকা দিতে পারেননি; পরে একসঙ্গে দিয়েছেন। তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বেশিরভাগই টাকা না দেওয়ায় আদায় পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে গেছে। ভালো গ্রাহকদের অনেকেই করোনার কারণে খারাপ অবস্থায় পড়েছেন। তবে এমন উদাহরণও রয়েছে, ঋণগ্রহীতা অন্য সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা দিয়েছেন।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা সব সময় যে কোনো সুবিধা নিতে চান। ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপি থেকে মুক্ত থাকার জন্য আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নেন। সামর্থ্য থাকলেও ডেফারেল সুবিধা অনেকেই নিচ্ছেন। তবে হাতে টাকা থাকলে ঋণ শোধ করা উচিত। কেননা পরিশোধ না করলে তো তার সুদ ও দেনা বাড়বেই।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ঋণ আদায় বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলোর অধিক সতর্কতা ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও প্রতি বছরই নতুন করে কিছু ঋণখেলাপি হয়। করোনার কারণে এবার খেলাপি ঋণ বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। অথচ পদ্ধতিগত কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি কমেছে। এতে করে কাগুজে মুনাফা দেখানোর সুযোগ বেড়েছে। পরিচালন মুনাফার বিপরীতে সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর পরিশোধ এবং লভ্যাংশ হিসেবে অর্থ নিয়ে গেলে প্রকৃত অর্থে কারও কারও লোকসান হবে। ফলে করোনার মধ্যে ঢালাও সুবিধার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সুযোগ করে দেওয়া ঠিক হয়নি। ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ের এমন অনেক ঋণগ্রহীতা আছেন আয় বা বেতন-ভাতা নিয়মিত থাকলেও টাকা দেননি। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের মধ্যে আগামীতে ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে এক ধরনের শিথিল মানসিকতা তৈরি হতে পারে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, পদ্ধতিগত কারণে ২০২০ সালে কোনো ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন খারাপ হবে না। কেননা, আদায় না করেই ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে আয় দেখানোর সুযোগ পেয়েছে। আবার নতুন করে কোনো ঋণখেলাপি না হওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের প্রয়োজনীতাও বাড়েনি। এরকম অবস্থায় সব নিয়মিত ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত এক শতাংশ প্রভিশন রাখার জন্য গত ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিলেও বিভিন্ন পক্ষের অদৃশ্য চাপে সে অবস্থান থেকে সরে আসতে হয়েছে। পরবর্তী এক নির্দেশনার মাধ্যমে শুধু করোনার এ সময়ে আদায় না হওয়া ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত এক শতাংশ প্রভিশন রাখতে বলা হয়। এতে করে ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত হলে হয়তো দেখা যাবে, আদায় কমলেও কর ও লভ্যাংশ হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। পদ্ধতিগত কারণে নিয়মিত দেখানো এসব ঋণ পরবর্তী সময়ে খেলাপি হলে তখন ব্যাপক চাপে পড়বে ব্যাংক। সূত্র: সমকাল

শেয়ার করুন

x
English Version

করোনায় ছাড় দিতে গিয়ে খারাপ অবস্থায় ব্যাংক খাত

আপডেট: ১০:৩৪:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১

করোনার কারণে কিস্তি পরিশোধ না করলেও ২০২০ সালে কাউকে ঋণখেলাপি করা হয়নি। উল্টো ব্যবসা সচল রাখতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার আওতায় কম সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। আর যারা ঋণ পরিশোধ করেননি, তাদের মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকলেও ইচ্ছা করেই অনেকে ব্যাংকের টাকা দেননি। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমেছে। খারাপ অবস্থায় পড়েছে ব্যাংক ব্যাংক। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির আনুষ্ঠানিক কোনো সংজ্ঞা নেই। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকার পরও যারা দেন না, তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইচ্ছাকৃত এসব খেলাপির বেশিরভাগই এক খাতের নামে ঋণ নিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সক্ষমতা যাচাই না করে প্রভাবশালীদের সহায়তায় ঋণ পেয়ে যান। এভাবে নেওয়া ঋণ বিদেশে পাচার বা বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িতে বিনিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত থাকেন। কৃত্রিম সংকটের বৈধতা পেতে কখনও ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনের পথ বেছে নেন। প্রতিবারই গ্রেস পিরিয়ড (কিস্তি পরিশোধ না করার সময়) নিয়ে ঋণ পরিশোধে বিরত থাকেন। গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে নতুন অজুহাত দাঁড় করান। ঘুরেফিরে তারা আবার আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করা থেকে বিরত থাকেন।

করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে ২০২০ সালে কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর গত ১৯ মার্চের এক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রথমে জুন পর্যন্ত বিশেষ এ ছাড় দেওয়া হয়। পরে দুই দফায় তিন মাস করে সময় বাড়িয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। ব্যাংকের টাকা দিতে চান না- এরকম একটি পক্ষ এই সুযোগ আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল। তবে ঢালাওভাবে আর সুযোগ না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ২৭ জানুয়ারির ব্যাংকার্স সভায় এমডিরা বলেন, বিশেষ ছাড়ের কারণে ইচ্ছে করে ঋণ পরিশোধ না করার একটি পক্ষ গড়ে উঠছে। এ প্রেক্ষাপটে নতুন করে আর সময় বাড়ানো হয়নি। যদিও ব্যবসায়ীদের কিস্তিপ্রতি ঋণের চাপ কমাতে শুধু মেয়াদি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও দুই বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।

বেসরকারি খাতের এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ব্যবসা ভালো থাকলেও ঋণ পরিশোধ না করার জন্য সব সময় একটি পক্ষ সুযোগ খোঁজে। তারা কখনও ঋণ পুনঃতফসিল চান বা পুনর্গঠন চান, কখনও আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। করোনার কারণে এবার যখন ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি হবেন না জানতে পেরেছেন, তখন ইচ্ছা করেই অনেকে ব্যাংকের টাকা দেননি। এই অর্থ তারা হয়তো অন্য কাজে খাটিয়েছেন। এর বাইরে করোনার আগেই বিপুল পরিমাণের অর্থ দীর্ঘ মেয়াদে পুনঃতফসিল করে দেওয়া হয়। তখন সুদহারও কমিয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে কিস্তির পরিমাণ কমে ঋণ আদায়ের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা এখন করোনার দোহাই দিয়ে বিশেষ সুবিধার মেয়াদ আরও বাড়াতে চাইছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকার ঋণ স্থিতির মধ্যে ডেফারেল সুবিধার আওতায় ছিল দুই লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই লাখ ১৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে কোনো কিস্তি পরিশোধ হয়নি। আর ৩৬ হাজার ৭১১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে কিছু কিস্তি পরিশোধ হয়েছে। অবশ্য ডেফারেল সুবিধা পাওয়া বিপুল অঙ্কের এই ঋণ গত বছরই পরিশোধ হওয়ার কথা ছিল- এমনটি নয়। তবে অধিকাংশই পরিশোধ না করায় ঋণ আদায় ব্যাপক কমেছে। গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু ছয় মাসে আদায় কমেছে ৮১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে নিয়মিত গ্রাহকদের থেকে আদায় ৭৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা কমে দুই লাখ ৬০ হাজার ৯০১ কোটি টাকায় নেমেছে। আর ঋণখেলাপিদের থেকে আদায় ব্যাপকভাবে কমে দুই হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে যেখানে নয় হাজার ২৬৩ কোটি টাকা আদায় ছিল। অক্টোবর-ডিসেম্বরের ঋণ আদায়ের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। শেষ তিন মাসেও আদায় অনেক কম হবে বলে জানান ব্যাংকাররা। ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধার কারণে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা কমে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় নেমেছে। মোট ঋণের যা মাত্র ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যত সমস্যাই হোক, যারা টাকা দেওয়ার দিয়ে দেন। যারা দিতে চান না তারা নানা ছুতো খোঁজেন। ইচ্ছাকৃত এসব ঋণখেলাপিকে বারবার সুবিধা দিলে অন্যরা বেকায়দায় পড়েন। ফলে ডেফারেল সুবিধার মেয়াদ না বাড়ানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। যত দাবিই আসুক, আগামীতে এটি আর বাড়ানো ঠিক হবে না। এতে ঋণ পরিশোধ না করার নতুন একটি গ্রুপ তৈরি হবে। তবে প্রকৃত সমস্যা বিবেচনায় কেস টু কেস ভিত্তিতে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।

মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিউল আজম সম্প্রতি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুবিধার কারণে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা থাকলেও অনেকে টাকা দেননি। করোনার কারণে ট্যুরিজম, ট্রাভেলস, কমিউনিটি সেন্টারসহ কিছু খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দৃশ্যমানভাবে দেশে বিক্রি এবং রপ্তানি থেকে আয় আসছে। অথচ করোনার দোহাই দিয়ে টাকা পরিশোধ করছেন না, এমন ঋণগ্রহীতা অনেক। যে কারণে ব্যাংকাররা মনে করেন, ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়া ঠিক নয়। এ ধরনের সুবিধা কেস টু কেস ভিত্তিতে দিলে ভালো হয়।
সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ক্রিসেন্ট লেদার, অ্যাননটেক্স, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হলমার্ক, মিশম্যাপ, এসএ গ্রুপ, আনন্দ শিপইয়ার্ড, ইলিয়াস ব্রাদার্স, কম্পিউটার সোর্সসহ বেশিরভাগ বড় ঋণখেলাপিই ইচ্ছাকৃত বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের অনেকেই টাকা নিয়ে বিদেশে পালানোর পর অর্থ পাচারের মামলা করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কেউ কেউ আবার হেলিপ্যাডসহ দেশে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যদিও এসব খেলাপির দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হতে দেখা যায়নি। মাঝেমধ্যে সরকার সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা দিয়ে থাকে। গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী। গত অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা তিন লাখ ৩৫ হাজার বলে জানান তিনি।
কয়েকটি ব্যাংকের এমডি এবং শাখা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণ পরিশোধ যারা করছেন না, তাদের বেশিরভাগই পুরোনো খেলাপি। তাদের অনেকেই বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন কিংবা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নিয়মিত দেখিয়ে আসছেন। করোনার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই ঋণ শোধ করেননি। আর আগে থেকে যারা নিয়মিত ঋণ ফেরত দিতেন, তাদের অনেকেই নিজ থেকে যোগাযোগ করে টাকা দিয়েছেন। নিয়মিত পরিশোধকারীদের একটি বড় অংশ এপ্রিল ও মে মাসের লকডাউনে বন্ধের মধ্যে টাকা দিতে পারেননি; পরে একসঙ্গে দিয়েছেন। তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বেশিরভাগই টাকা না দেওয়ায় আদায় পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে গেছে। ভালো গ্রাহকদের অনেকেই করোনার কারণে খারাপ অবস্থায় পড়েছেন। তবে এমন উদাহরণও রয়েছে, ঋণগ্রহীতা অন্য সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা দিয়েছেন।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা সব সময় যে কোনো সুবিধা নিতে চান। ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপি থেকে মুক্ত থাকার জন্য আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নেন। সামর্থ্য থাকলেও ডেফারেল সুবিধা অনেকেই নিচ্ছেন। তবে হাতে টাকা থাকলে ঋণ শোধ করা উচিত। কেননা পরিশোধ না করলে তো তার সুদ ও দেনা বাড়বেই।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ঋণ আদায় বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলোর অধিক সতর্কতা ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও প্রতি বছরই নতুন করে কিছু ঋণখেলাপি হয়। করোনার কারণে এবার খেলাপি ঋণ বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। অথচ পদ্ধতিগত কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি কমেছে। এতে করে কাগুজে মুনাফা দেখানোর সুযোগ বেড়েছে। পরিচালন মুনাফার বিপরীতে সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর পরিশোধ এবং লভ্যাংশ হিসেবে অর্থ নিয়ে গেলে প্রকৃত অর্থে কারও কারও লোকসান হবে। ফলে করোনার মধ্যে ঢালাও সুবিধার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সুযোগ করে দেওয়া ঠিক হয়নি। ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ের এমন অনেক ঋণগ্রহীতা আছেন আয় বা বেতন-ভাতা নিয়মিত থাকলেও টাকা দেননি। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের মধ্যে আগামীতে ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে এক ধরনের শিথিল মানসিকতা তৈরি হতে পারে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, পদ্ধতিগত কারণে ২০২০ সালে কোনো ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন খারাপ হবে না। কেননা, আদায় না করেই ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে আয় দেখানোর সুযোগ পেয়েছে। আবার নতুন করে কোনো ঋণখেলাপি না হওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের প্রয়োজনীতাও বাড়েনি। এরকম অবস্থায় সব নিয়মিত ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত এক শতাংশ প্রভিশন রাখার জন্য গত ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিলেও বিভিন্ন পক্ষের অদৃশ্য চাপে সে অবস্থান থেকে সরে আসতে হয়েছে। পরবর্তী এক নির্দেশনার মাধ্যমে শুধু করোনার এ সময়ে আদায় না হওয়া ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত এক শতাংশ প্রভিশন রাখতে বলা হয়। এতে করে ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত হলে হয়তো দেখা যাবে, আদায় কমলেও কর ও লভ্যাংশ হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। পদ্ধতিগত কারণে নিয়মিত দেখানো এসব ঋণ পরবর্তী সময়ে খেলাপি হলে তখন ব্যাপক চাপে পড়বে ব্যাংক। সূত্র: সমকাল