০৩:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

খাদ্যে ২ শতাংশের বেশি ট্রান্স ফ্যাট থাকবে না, আসছে প্রবিধানমালা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৭:৪০:৫৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২১
  • / ৪১৫৫ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল ডেস্কঃ ২ শতাংশের বেশি ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ বা অসম্পৃক্ত চর্বি) থাকা কোনো খাদ্যদ্রব্য বিক্রি, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও আমদানি করা যাবে না। এমন নিয়ম রেখে খসড়া ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা-২০২১’ প্রণয়ন করেছে সরকার। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খসড়াটি প্রণয়ন করেছে। এখন খসড়াটির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

ট্রান্স ফ্যাট এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি, যা ডালডা কিংবা বনস্পতি ঘি নামে আমাদের দেশে পরিচিত। এটাকে পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েলও (পিএইচও) বলা হয়। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রায় দাহ্যতেল বা চর্বিও ট্রান্স ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশ। কিন্তু আমাদের দেশে তেল-জাতীয় খাদ্যে এই মাত্রা অনেক বেশি।

বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে উচ্চমাত্রায় চর্বি জাতীয় পদার্থ ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ) থাকায় এসব খাবার গ্রহণ হৃদরোগসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে ইতোমধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন সংগঠন। এই প্রেক্ষাপটে প্রবিধানমালাটি প্রণয়ন করেছে সরকার।

এ বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইনি সাপোর্ট থাকলে কাজ করতে সুবিধা হয়। প্রবিধানমালাটি হলে যারা ট্রান্স ফ্যাট তৈরি করেন তাদের নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পারবো আমরা। এ ব্যাপারে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনারও চিন্তা-ভাবনা আমাদের আছে।’

তিনি বলেন, ‘ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড শুধু কারখানায় তৈরি হয় তা নয়; হোটেলে একই তেল বারবার ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমেও ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি হতে পারে। আমরা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে প্রবিধানমালার খসড়াটি করেছি। সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়ার পর, যদি নতুন কিছু পাওয়া যায় সেগুলো খসড়ায় যুক্ত হবে। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নিয়ে এটি শিগগির চূড়ান্ত হবে।’

ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে এ বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল বেসরকারি সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)। প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিজ্ঞান পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করেছে হৃদরোগের সঙ্গে এর (ট্রান্স ফ্যাট) সংযোগ আছে। তরুণদের মধ্যে এটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এর বড় একটা কারণ হচ্ছে, খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যের মধ্যে এই বিষাক্ত পদার্থের বিষয়ে হয়তো আমরা জানতাম না। অজান্তেই আমরা এটা খেয়ে ফেলতাম। এতে হৃদরোগের প্রকোপটা বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘হৃদরোগ এবং তা থেকে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ থেকে শিল্প উৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। এ বিষয়ে কানাডা, ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশ আইন করেছে, সেখানে সুফল পাওয়া গেছে। সেখানে হৃদরোগের ঝুঁকি কমেছে- এ বিষয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল আছে।’

‘আমরা মনে করছি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে সেটি খুবই সময়োপযোগী। আমরা দ্রুত প্রবিধানমালাটি চূড়ান্ত করে বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। দ্রুত প্রবিধানমালাটি চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন করলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উপকার হবে। হৃদরোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি’—বলেন এ বি এম জুবায়ের।

প্রজ্ঞার ট্রান্স ফ্যাট প্রজেক্টের টিম লিডার মো. হাসান শাহরিয়ার জানান, মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রান্স ফ্যাট ঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এনএইচএফএইচআরআই) একটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। গবেষণায় ২৪টি নমুনা সংগ্রহ করে পর্তুগালের ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট ফুড কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির সহায়তায় সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড বা টিএফএ মাত্রা নির্ণয় করা হয়। পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।

২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনের সভাকক্ষে ‘ট্রান্স ফ্যাট ও হৃদরোগ ঝুঁকি এবং গণমাধ্যমের করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় জানানো হয়, ঢাকার স্থানীয় বাজার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগ্রহ করা ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুট নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় নমুনা বিস্কুটগুলোতে ৫ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবারের কারণে স্ট্রোক এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে সার্বিকভাবে মৃত্যুঝুঁকি ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় বলেও কর্মশালায় জানানো হয়।

খসড়া প্রবিধানমালায় যা আছে
খসড়ায় বলা হয়, চর্বির ইমালসনসহ যে কোনো তেল এবং চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের অংশ বা যে কোনো খাদ্যের অংশ, যা মানুষের খাওয়ার উদ্দেশ্যে বা খাওয়ার উদ্দেশ্যে অনুমোদিত—এমন ক্ষেত্রে এই প্রবিধানমালা প্রযোজ্য হবে।

প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, মোড়কাবদ্ধ খাদ্য, মোড়কবিহীন খাদ্য, সরাসরি আহার্য খাদ্য (রেডি-টু-ইট) বা যে কোনো খাদ্য এবং খাদ্য প্রস্তুতের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামালের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে। তবে রুমিন্যান্টজাত (জাবরকাটা প্রাণী থেকে আসা) ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (আরপি-টিএফএ), প্রাণীর চর্বিতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড বা অন্য কোনো আইনের অধীন পরিচালিত খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এই প্রবিধানমালা প্রযোজ্য হবে না।

খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডের সর্বোচ্চ মাত্রার বিষয়ে প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, রুমিন্যান্টজাত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড ছাড়া চর্বির ইমালসনসহ যে কোনো তেল এবং চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বা যে কোনো খাদ্যের অংশ, যা মানুষের আহার্যের উদ্দেশ্যে বা মানুষের আহার্যের উদ্দেশ্যে অনুমোদিত বা খুচরা ব্যবসা, ক্যাটারিং ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, প্রতিষ্ঠান, বেকারি বা যেকোনো খাদ্য স্থাপনার খাদ্য প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যাতে ২ শতাংশের (প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম) বেশি ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড বিদ্যমান তা বিক্রি, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং আমদানিসহ কোনোরূপ খাদ্য ব্যবসা করা যাবে না।

রুমিন্যান্টজাত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড ছাড়া ২ শতাংশের (প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম) বেশি ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড আছে এমন প্রক্রিয়াজাত, মোড়কাবদ্ধ, সরাসরি আহার্য খাদ্য বিক্রি, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন, আমদানিসহ এই ধরনের খাদ্যের ব্যবসা করা যাবে না।

২ শতাংশের (প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম) বেশি প্রাণিজ উৎসজাত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য ব্যবসায়ী প্রমাণ দাখিল করতে বাধ্য থাকবেন বলে প্রবিধানমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, বাধ্যতামূলকভাবে মোড়কাবদ্ধ খাদ্যের লেবেলে ২০১৭ সালের মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা অনুযায়ী ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড সম্পর্কিত তথ্যাদি ঘোষণা করতে হবে।

যদি কোনো খাদ্যে আংশিকভাবে হাইড্রোজেনেটেড তেলের (পিএইচও) ব্যবহৃত হয় তবে এর নির্দিষ্ট পরিমাণসহ তথ্যাদি মোড়কাবদ্ধ খাদ্যের লেবেলিংয়ের উপাদান তালিকায় উল্লেখ করতে হবে। পিএইচও’র সংমিশ্রণে গঠিত কোনো খাদ্য উপকরণ (যেমন- শটেনিং বা মার্জারিন) কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হলে পিএইচও’র পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্যাদি সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। তবে উপাদান তালিকায় পণ্যটি ‘নন-হাইড্রোজেনেটেড’ বা ‘আন-হাইড্রোজেনেটেড’ এমন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।

মোড়কীকরণ, লেবেলিং, বিপণন বা বিজ্ঞাপনে কোনো খাদ্যপণ্য টিএফএমুক্ত এমন দাবি করা যাবে না।

খসড়া প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নির্ধারণের জন্য বিশ্লেষণ পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, বিশ্বাসযোগ্য এবং ধারাবাহিকভাবে পুনরুৎপাদনযোগ্য হতে হবে। খাদ্যোপকরণে টিএফএ’র পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘ডব্লিউএইচও প্রটোকল ফর মেসারিং ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডস ইন ফুডস’ অনুসরণসহ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডাডারাইজেশন (আইএসও), অ্যাসোসিয়েশন অব অফিসিয়াস অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট (এওএসি), আমেরিকান ওয়েল কেমিস্ট সোসাইটি (এওসিএস), ইন্টারন্যাশনাল ডেইরি ফেডারেশন (আইডিএফ) এবং কোডেক্সের সময়ে সময়ে হালনাগাদ করা বিশ্লেষণ পদ্ধতি রেফারেন্স হিসেবে অনুসৃত হবে।

সূত্রঃ জাগোনিউজ

শেয়ার করুন

x
English Version

খাদ্যে ২ শতাংশের বেশি ট্রান্স ফ্যাট থাকবে না, আসছে প্রবিধানমালা

আপডেট: ০৭:৪০:৫৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২১

বিজনেস জার্নাল ডেস্কঃ ২ শতাংশের বেশি ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ বা অসম্পৃক্ত চর্বি) থাকা কোনো খাদ্যদ্রব্য বিক্রি, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও আমদানি করা যাবে না। এমন নিয়ম রেখে খসড়া ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা-২০২১’ প্রণয়ন করেছে সরকার। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খসড়াটি প্রণয়ন করেছে। এখন খসড়াটির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

ট্রান্স ফ্যাট এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি, যা ডালডা কিংবা বনস্পতি ঘি নামে আমাদের দেশে পরিচিত। এটাকে পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েলও (পিএইচও) বলা হয়। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রায় দাহ্যতেল বা চর্বিও ট্রান্স ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশ। কিন্তু আমাদের দেশে তেল-জাতীয় খাদ্যে এই মাত্রা অনেক বেশি।

বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে উচ্চমাত্রায় চর্বি জাতীয় পদার্থ ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ) থাকায় এসব খাবার গ্রহণ হৃদরোগসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে ইতোমধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন সংগঠন। এই প্রেক্ষাপটে প্রবিধানমালাটি প্রণয়ন করেছে সরকার।

এ বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইনি সাপোর্ট থাকলে কাজ করতে সুবিধা হয়। প্রবিধানমালাটি হলে যারা ট্রান্স ফ্যাট তৈরি করেন তাদের নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পারবো আমরা। এ ব্যাপারে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনারও চিন্তা-ভাবনা আমাদের আছে।’

তিনি বলেন, ‘ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড শুধু কারখানায় তৈরি হয় তা নয়; হোটেলে একই তেল বারবার ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমেও ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি হতে পারে। আমরা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে প্রবিধানমালার খসড়াটি করেছি। সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়ার পর, যদি নতুন কিছু পাওয়া যায় সেগুলো খসড়ায় যুক্ত হবে। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নিয়ে এটি শিগগির চূড়ান্ত হবে।’

ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে এ বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল বেসরকারি সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)। প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিজ্ঞান পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করেছে হৃদরোগের সঙ্গে এর (ট্রান্স ফ্যাট) সংযোগ আছে। তরুণদের মধ্যে এটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এর বড় একটা কারণ হচ্ছে, খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যের মধ্যে এই বিষাক্ত পদার্থের বিষয়ে হয়তো আমরা জানতাম না। অজান্তেই আমরা এটা খেয়ে ফেলতাম। এতে হৃদরোগের প্রকোপটা বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘হৃদরোগ এবং তা থেকে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ থেকে শিল্প উৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। এ বিষয়ে কানাডা, ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশ আইন করেছে, সেখানে সুফল পাওয়া গেছে। সেখানে হৃদরোগের ঝুঁকি কমেছে- এ বিষয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল আছে।’

‘আমরা মনে করছি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে সেটি খুবই সময়োপযোগী। আমরা দ্রুত প্রবিধানমালাটি চূড়ান্ত করে বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। দ্রুত প্রবিধানমালাটি চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন করলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উপকার হবে। হৃদরোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি’—বলেন এ বি এম জুবায়ের।

প্রজ্ঞার ট্রান্স ফ্যাট প্রজেক্টের টিম লিডার মো. হাসান শাহরিয়ার জানান, মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রান্স ফ্যাট ঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এনএইচএফএইচআরআই) একটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। গবেষণায় ২৪টি নমুনা সংগ্রহ করে পর্তুগালের ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট ফুড কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির সহায়তায় সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড বা টিএফএ মাত্রা নির্ণয় করা হয়। পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।

২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনের সভাকক্ষে ‘ট্রান্স ফ্যাট ও হৃদরোগ ঝুঁকি এবং গণমাধ্যমের করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় জানানো হয়, ঢাকার স্থানীয় বাজার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগ্রহ করা ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুট নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় নমুনা বিস্কুটগুলোতে ৫ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবারের কারণে স্ট্রোক এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে সার্বিকভাবে মৃত্যুঝুঁকি ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় বলেও কর্মশালায় জানানো হয়।

খসড়া প্রবিধানমালায় যা আছে
খসড়ায় বলা হয়, চর্বির ইমালসনসহ যে কোনো তেল এবং চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের অংশ বা যে কোনো খাদ্যের অংশ, যা মানুষের খাওয়ার উদ্দেশ্যে বা খাওয়ার উদ্দেশ্যে অনুমোদিত—এমন ক্ষেত্রে এই প্রবিধানমালা প্রযোজ্য হবে।

প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, মোড়কাবদ্ধ খাদ্য, মোড়কবিহীন খাদ্য, সরাসরি আহার্য খাদ্য (রেডি-টু-ইট) বা যে কোনো খাদ্য এবং খাদ্য প্রস্তুতের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামালের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে। তবে রুমিন্যান্টজাত (জাবরকাটা প্রাণী থেকে আসা) ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (আরপি-টিএফএ), প্রাণীর চর্বিতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড বা অন্য কোনো আইনের অধীন পরিচালিত খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এই প্রবিধানমালা প্রযোজ্য হবে না।

খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডের সর্বোচ্চ মাত্রার বিষয়ে প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, রুমিন্যান্টজাত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড ছাড়া চর্বির ইমালসনসহ যে কোনো তেল এবং চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বা যে কোনো খাদ্যের অংশ, যা মানুষের আহার্যের উদ্দেশ্যে বা মানুষের আহার্যের উদ্দেশ্যে অনুমোদিত বা খুচরা ব্যবসা, ক্যাটারিং ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, প্রতিষ্ঠান, বেকারি বা যেকোনো খাদ্য স্থাপনার খাদ্য প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যাতে ২ শতাংশের (প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম) বেশি ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড বিদ্যমান তা বিক্রি, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং আমদানিসহ কোনোরূপ খাদ্য ব্যবসা করা যাবে না।

রুমিন্যান্টজাত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড ছাড়া ২ শতাংশের (প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম) বেশি ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড আছে এমন প্রক্রিয়াজাত, মোড়কাবদ্ধ, সরাসরি আহার্য খাদ্য বিক্রি, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন, আমদানিসহ এই ধরনের খাদ্যের ব্যবসা করা যাবে না।

২ শতাংশের (প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম) বেশি প্রাণিজ উৎসজাত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য ব্যবসায়ী প্রমাণ দাখিল করতে বাধ্য থাকবেন বলে প্রবিধানমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, বাধ্যতামূলকভাবে মোড়কাবদ্ধ খাদ্যের লেবেলে ২০১৭ সালের মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা অনুযায়ী ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড সম্পর্কিত তথ্যাদি ঘোষণা করতে হবে।

যদি কোনো খাদ্যে আংশিকভাবে হাইড্রোজেনেটেড তেলের (পিএইচও) ব্যবহৃত হয় তবে এর নির্দিষ্ট পরিমাণসহ তথ্যাদি মোড়কাবদ্ধ খাদ্যের লেবেলিংয়ের উপাদান তালিকায় উল্লেখ করতে হবে। পিএইচও’র সংমিশ্রণে গঠিত কোনো খাদ্য উপকরণ (যেমন- শটেনিং বা মার্জারিন) কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হলে পিএইচও’র পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্যাদি সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। তবে উপাদান তালিকায় পণ্যটি ‘নন-হাইড্রোজেনেটেড’ বা ‘আন-হাইড্রোজেনেটেড’ এমন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।

মোড়কীকরণ, লেবেলিং, বিপণন বা বিজ্ঞাপনে কোনো খাদ্যপণ্য টিএফএমুক্ত এমন দাবি করা যাবে না।

খসড়া প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নির্ধারণের জন্য বিশ্লেষণ পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, বিশ্বাসযোগ্য এবং ধারাবাহিকভাবে পুনরুৎপাদনযোগ্য হতে হবে। খাদ্যোপকরণে টিএফএ’র পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘ডব্লিউএইচও প্রটোকল ফর মেসারিং ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডস ইন ফুডস’ অনুসরণসহ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডাডারাইজেশন (আইএসও), অ্যাসোসিয়েশন অব অফিসিয়াস অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট (এওএসি), আমেরিকান ওয়েল কেমিস্ট সোসাইটি (এওসিএস), ইন্টারন্যাশনাল ডেইরি ফেডারেশন (আইডিএফ) এবং কোডেক্সের সময়ে সময়ে হালনাগাদ করা বিশ্লেষণ পদ্ধতি রেফারেন্স হিসেবে অনুসৃত হবে।

সূত্রঃ জাগোনিউজ