১১:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

গবেষণা বাড়াতে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৩:০৭:২৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী ২০২১
  • / ৪১৩৮ বার দেখা হয়েছে

আমরা সব রেটিংয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি
-ড. একে আজাদ চৌধুরী

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, শুধু সরকারি-বেসরকারি নয় সবধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণায় পিছিয়ে পড়েছে। এজন্য আমরা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রেটিং-র‌্যাংকিং উভয় দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। জ্ঞান সৃষ্টি না হলে শিক্ষকতার মানও নেমে যাবে। ভালো ও উঁচুমানের গবেষণা না হলে তা ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালে’ প্রকাশের জন্য বিবেচনা হয় না। গবেষণা না হলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও আগায় না। এমন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যও কমে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসির এই অধ্যাপক বলেন, পিএইচডি হচ্ছে একজন শিক্ষকের গবেষণা জগতে প্রবেশদ্বার। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের এই ডিগ্রি আছে-সেটা আশাব্যঞ্জক দিক নয়। যিনি নিজেই পিএইচডি বা গবেষণা করেননি, তিনি কী শিক্ষা দেবেন বা গবেষণায় তত্ত্বাবধান করবেন কীভাবে। উচ্চশিক্ষায় এ ধরনের শিক্ষকের দ্বারা কী হবে-তা আমি জানি না। তবে ভুলত্রুটি শুধরে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন-এমনটি আশা করতে পারি। কিন্তু কত শতাংশ শিক্ষক উদ্যোগী হবেন, সেটা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করাই যেতে পারে।

তিনি বলেন, আমি আশাবাদী মানুষ। আশার আলো দেখতে চাই। অতীতের চেয়ে বর্তমানে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। ইউজিসির তত্ত্বাবধানে উচ্চশিক্ষার জন্য যে প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেখানে কেবল গবেষণায় সহায়তা হিসাবে ৪০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। এ সংক্রান্ত প্রকল্প (হেকেপ) চলে গিয়েছিল। আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রজেক্ট পুনরুজ্জীবিত করা হয়। তখন প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণা সহায়তা পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তখন ২৭টি প্রজেক্ট পেয়েছিল। ওই প্রকল্প শেষে অবশ্য এখন পর্যন্ত নতুন আর নেওয়া যায়নি।

অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, সেই প্রকল্প বর্তমানে চালু নেই। তবে এর চেয়েও চরম সত্য হচ্ছে, গবেষণায় বরাদ্দ একদম কম। গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না দেওয়া হলে ভালো ও উঁচুমানের গবেষণা করা সম্ভব নয়। এখান-ওখান থেকে নিয়ে গবেষণা করা যায়। কিন্তু সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘অ্যাপ্লাইড রিসার্চ’ (ব্যবহারিক গবেষণা) হয়। মৌলিক গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ হওয়া দরকার। পাশাপাশি শিক্ষকরা যাতে গবেষণায় উৎসাহী ও নিয়োজিত হন সে ধরনের প্রয়োজনীয় সংস্কারও করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, তবে হতাশার মধ্যে আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় থেকে এই খাতে বাজেট রাখা হচ্ছে। গবেষকরা সেখান থেকে তহবিল পাচ্ছেন। এটা শুভ উদ্যোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২০-২৫ কোটি টাকার তহবিল পাওয়া গেছে। এজন্য উদ্যোগী শিক্ষক ও গবেষকদের কাছ থেকে প্রকল্প প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। সোমবার প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর মূল্যায়ন বৈঠকে আমিও ছিলাম। অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব এসেছে। এর মানে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষকেরা চিন্তা করেন। তারা চাইলে ভালো কিছু করতে পারবেন। এটাই আমাকে আশাবাদী করছে।

তিনি আরও বলেন, তার পরও বলা যায়, বর্তমানে গবেষণায় যে বরাদ্দ আছে তা যথেষ্ট নয়। আমার অনুরোধ থাকবে, এ ধরনের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া) বরাদ্দ যেন অব্যাহত থাকে। তা ‘ওয়ান-টাইম’ যেন না হয়। আমরা বর্তমানে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেট করছি। দেশ যে সমৃদ্ধ হয়েছে এটা তার বড় প্রমাণ। এমন অর্থনীতির দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বাজেটের বাইরে কেবল গবেষণায় বড় ধরনের বরাদ্দ রাখা সম্ভব। টেকসই ও স্থায়ী (ভায়াবল) গবেষণার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখতে সক্ষম। অর্থনীতির পাশাপাশি মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টিতেও আমরা সমৃদ্ধিশালী হতে চাই। গবেষণায় আলাদা বাজেট দেওয়া হলে এর ‘রিটার্ন’ (ইতিবাচক ফল) দেশ অবশ্যই পাবে। তা ছাড়া বৈশ্বিকভাবে আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (এসডিজি) নিয়ে এগোচ্ছি। দেশের টেকসই উন্নয়ন এবং উন্নত দেশের আসনে উন্নীত হতে গবেষণায় বরাদ্দের বিকল্প নেই।
অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জ্ঞানগত দিকে নয় উন্নতি হচ্ছে বস্তুগতভাবে
-ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বরেণ্য শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষণা সমার্থক শব্দ। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল স্নাতক আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানের জন্য নয়। গবেষণার জন্যই স্নাতক-স্নাতকোত্তর স্তরে শিক্ষার্থী নেয়া হয়ে থাকে, যাদের একটি অংশ পরবর্তীকালে গবেষণায় নিয়োজিত হবেন। তারা এমফিল-পিএইচডি গবেষণা করবেন। জ্ঞানের নতুন নতুন দিক 

উন্মোচিত করবেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয় মানেই হলো গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা নির্ণীত হয় গবেষণা ও প্রকাশনা দ্বারা; কতসংখ্যক ডিগ্রি দিল সেটা দিয়ে নয়।

তিনি বলেন, গবেষণা কেবল শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষকরাও করবেন। তারা সামষ্টিকভাবে জাতিকে জ্ঞানগতভাবে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন। জ্ঞানগত সচ্ছলতার দিকে এগিয়ে নেবেন তারা। একজন নবীন গ্রাজুয়েট যখন পেশায় আসবেন তখন তিনি তার পূর্বসূরিকে দেখে উৎসাহিত হবেন। উত্তরসূরির এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্বটা হচ্ছে তিনি গবেষণা করবেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে দৃষ্টান্ত করবেন।

অধ্যাপক চৌধুরীর মতে, গবেষণার জন্য শিক্ষকদের আগ্রহ থাকতে হবে। এটা দুইভাবে করা যায়। একটি হচ্ছে, মর্যাদা বাড়িয়ে। আরেকটি হচ্ছে, তার পেশাগত জীবনে এর জন্য আলাদা মূল্যায়ন থাকবে। পদোন্নতিতে পিএইচডি ডিগ্রির প্রয়োজন আছে কি না। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে পদায়নের জন্য উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা কিংবা প্রকাশনার কতটা গুরুত্ব আছে। এসব হচ্ছে মর্যাদার দৃষ্টান্ত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসবের বিবেচনা নেই। এর মানে হচ্ছে, পিএইচডি বা গবেষণার মর্যাদা নেই। গবেষণা বিমুখতা এটাই প্রমাণ করে। সমাজের প্রতিফলন পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়েও।

তিনি বলেন, আমরা বস্তুগতভাবে অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু জ্ঞানগত দিক থেকে উন্নতি হচ্ছে না। এর কারণ আছে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলেও গবেষণার মর্যাদা নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় কি শিক্ষকের বা তার মতামতের প্রয়োজন হয়? সমাজইবা কতটা মর্যাদা দেয়! আসলে গোটা ব্যবস্থাই জ্ঞানবিরোধী একটা অবস্থায় আছে।

আসলে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় ও বৃহত্তর সামাজিক ব্যবস্থারই অংশ। এরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকে এটা আমাদেরকে পথ দেখাবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় সেটা পারছে না। অন্য দিকে সমাজে সবকিছু পণ্যে পরিণত হয়েছে। সবকিছু আর্থিক মূল্যে বিচার করা হয়। গবেষণার ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি বিবেচনা পায়। তাই, এখন শিক্ষকদের মধ্যে অনেককে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী দেখা যায়। নিজ কর্মস্থলের পরে অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। এসবই দুঃখজনক ব্যাপার।

এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ বলেন, আমি শিক্ষকদের শাস্তি দেওয়ার পক্ষে নই। গবেষণায় তাদের উদ্বুদ্ধ করা যাবে না। এটা দুইভাবে করা যায়। প্রথমত, তাদের শাস্তির ভয় না দেখিয়ে উৎসাহিত করার কৌশল নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত সম্মান বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়টি বেশি জরুরি।

একজন শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রি করার পর তার মর্যাদা কী হলো আর অধিকসংখ্যক পিএইচডি তত্ত্বাবধান করলে একজন শিক্ষকের মর্যাদাগত কী বিবেচনা তিনি পেলেন-সেটা জরুরি। তিনি বলেন, গবেষণায় তহবিল আর পরিবেশও একটা বড় বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল থাকবে। এই সংখ্যা যত বেশি থাকবে তত মঙ্গল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থা থাকবে। সেখানে প্রকাশনা প্রকাশিত হবে। এভাবে গবেষণার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আরেকটি কাজ হচ্ছে অনুবাদ। এটা করলে একদিকে তিনি সমৃদ্ধ হবেন এবং কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলে তা দূর হবে।

পাশাপাশি তার এই অনুবাদ থেকে ছাত্রছাত্রী ও সার্বিকভাবে জনগণ উপকৃত হবেন। এ দিকেও তারা গুরুত্ব দিতে পারেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের গ্রহণ ও প্রকাশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এদিকেও দুর্বলতা বিরাজমান আছে। গবেষণার পাশাপাশি এদিকেও তারা গুরুত্ব দিতে পারেন।

তিনি বলেন, একটা লজ্জাজনক ব্যাপার হচ্ছে, গবেষণায় বরাদ্দ অপ্রতুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দের বেশির ভাগ বেতনভাতাসহ আনুষঙ্গিক খাতে চলে যায়। গবেষণার জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে, বরাদ্দ কম হলেও বেসরকারি উৎস বিশেষ করে অ্যালামনাইসহ অন্য খাত থেকে অনুদান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট সমৃদ্ধ করা যায়। এজন্য প্রথম কাজ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেকেই গবেষণা দিয়ে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে, অনেকে টাকা দিতে চান। কিন্তু আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পরিচয় তুলে ধরতে পারিনি।

বর্তমানে কিছু ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের রেওয়াজ চালু আছে। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান আর লেকচারের ব্যবস্থা আছে। গবেষণা চেয়ার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্তও আছে। এই ব্যবস্থায় অবশ্য কিছু উপকার হয়। তবে সার্বিকভাবে গবেষণার জন্য তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। এই কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিজের কাজ দিয়ে করতে হবে। গবেষণা হলে তহবিল আসবে। এই দায়িত্বটা পালন করতে হবে শিক্ষককেই। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি প্রকাশ পাবে।
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্বলতা আছে গবেষণা কর্মে 
-ড. এএসএম মাকসুদ কামাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, গবেষণা, শিক্ষণ ও গবেষণা-শিক্ষণ সংমিশ্রণে সাধারণত তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একটিও গড়ে ওঠেনি। কিছু শিক্ষণ বা ডিগ্রি প্রদানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আচরণ করছে। আর কিছু গবেষণা-শিক্ষণ উভয় চরিত্র নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য। আর কলেজ নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য নয়। বিদ্যমান জ্ঞানের আলোকে শিক্ষার্থী প্রস্তুত করে দেয় কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নতুন সৃষ্টির কাজে লাগায়।

তবে এটাও ঠিক যে, গবেষণা কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্বলতাও আছে। অনেক শিক্ষক আছেন যারা গবেষণা প্রস্তাবটি পর্যন্ত ঠিকমতো লিখতে পারেন না। এটা হওয়ার কারণ হচ্ছে, শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর অনেকেই পিএইচডি আর পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন না। এখন গবেষণা না করলে এসব তো কারও জানার কথা নয়।

গবেষণা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। সেক্ষেত্রে তাকে কেবল অ্যাসিস্ট্যান্ট লেকচারার হিসেবে থাকতে হয়। আর আমরা ভালো ফল করা একজন নবীন গ্রাজুয়েটকে নিয়োগ দিই। আবার এ ধরনের শিক্ষকদের অনেকেই বর্তমানে দেশের বাইরে গিয়ে ডিগ্রি করার ব্যাপারে আগ্রহী নন। যে কারণে দুই-তৃতীয়াংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি নেই। এমনটা হয়েছে আমাদের নিয়োগ আর পদোন্নতি নীতিমালার দুর্বলতার কারণে। এটির পাশাপাশি অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করা প্রয়োজন। বিপরীত দিকে এটাও ঠিক যে, ১০ হাজার ‘সাইটেশন’ (গবেষণা) আছে এমন বেশকিছু অধ্যাপক পাওয়া যাবে দেশে। ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালে’ (মানসম্মত প্রকাশনা প্রকাশের জন্য বৈশ্বিকভাবে সমাদৃত) গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে এমন শিক্ষক অনেক আছেন। প্রচারের অভাব, ওয়েবসাইটের দুর্বলতা এবং সৃষ্ট জ্ঞান জাতীয়ভাবে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা না থাকায় সেসব মানুষ জানছে না। পাশাপাশি এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পিছিয়ে যাচ্ছে।

আরেকটি দিক হচ্ছে, গবেষণার পরিবেশ ও সুযোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ওভারসিজ স্কলারশিপের মাধ্যমে শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে। জাতীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রী গবেষণা তহবিল আছে। কিন্তু সেখানে শিক্ষকদের অংশ খুবই কম। শিক্ষকদেরই মূলত উচ্চশিক্ষা আর বৈশ্বিক পর্যায়ে অবগাহন করা দরকার। যার শ্রেণিকক্ষে যেতে হয় না তাকে যদি এ ক্ষেত্রে রাখা হয় তাহলে সেটা কত যৌক্তিক তাও ভাবনার সময় এসেছে। শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরও কমে যাচ্ছে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ আগের চেয়ে সংখ্যা কমেছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া সম্পন্ন হলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরও কমবে। এসব কারণে যার প্রকৃত অর্থে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য উচ্চশিক্ষা দরকার তার পেছনে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।

সরকারের আর্থিক সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দও বাড়ছে। শতবর্ষ উপলক্ষে কেবল গবেষণার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গবেষণা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আমরা আরও সাড়ে ৪শ কোটি টাকা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আসলে সরকারের কাছে টাকা চাইতে হবে এবং চাওয়ার মতো অবস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আমরা সেটা পারিনি বলে বরাদ্দ পাচ্ছি না। এজন্য সরকারকে দায়ী করা সমীচীন নয়।

বাংলাদেশে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত চারটি, বুয়েট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিকেন্দ্রিক লেখাপড়ার পাশাপাশি গবেষণায়ও ভূমিকা রাখছে। আমরা অনেকেই খোঁজ রাখি না বলে তা জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকেও (সোমবার) দেড় শতাধিক গবেষণা প্রকল্প নিয়ে মূল্যায়ন বৈঠক হয়েছে। দেশের সিনিয়র অধ্যাপকরা তা মূল্যায়ন করেছেন। এখান থেকে নির্বাচিতরা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবেন গবেষণা কাজে। 
অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল
প্রোভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

x
English Version

গবেষণা বাড়াতে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

আপডেট: ০৩:০৭:২৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী ২০২১

আমরা সব রেটিংয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি
-ড. একে আজাদ চৌধুরী

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, শুধু সরকারি-বেসরকারি নয় সবধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণায় পিছিয়ে পড়েছে। এজন্য আমরা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রেটিং-র‌্যাংকিং উভয় দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। জ্ঞান সৃষ্টি না হলে শিক্ষকতার মানও নেমে যাবে। ভালো ও উঁচুমানের গবেষণা না হলে তা ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালে’ প্রকাশের জন্য বিবেচনা হয় না। গবেষণা না হলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও আগায় না। এমন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যও কমে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসির এই অধ্যাপক বলেন, পিএইচডি হচ্ছে একজন শিক্ষকের গবেষণা জগতে প্রবেশদ্বার। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের এই ডিগ্রি আছে-সেটা আশাব্যঞ্জক দিক নয়। যিনি নিজেই পিএইচডি বা গবেষণা করেননি, তিনি কী শিক্ষা দেবেন বা গবেষণায় তত্ত্বাবধান করবেন কীভাবে। উচ্চশিক্ষায় এ ধরনের শিক্ষকের দ্বারা কী হবে-তা আমি জানি না। তবে ভুলত্রুটি শুধরে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন-এমনটি আশা করতে পারি। কিন্তু কত শতাংশ শিক্ষক উদ্যোগী হবেন, সেটা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করাই যেতে পারে।

তিনি বলেন, আমি আশাবাদী মানুষ। আশার আলো দেখতে চাই। অতীতের চেয়ে বর্তমানে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। ইউজিসির তত্ত্বাবধানে উচ্চশিক্ষার জন্য যে প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেখানে কেবল গবেষণায় সহায়তা হিসাবে ৪০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। এ সংক্রান্ত প্রকল্প (হেকেপ) চলে গিয়েছিল। আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রজেক্ট পুনরুজ্জীবিত করা হয়। তখন প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণা সহায়তা পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তখন ২৭টি প্রজেক্ট পেয়েছিল। ওই প্রকল্প শেষে অবশ্য এখন পর্যন্ত নতুন আর নেওয়া যায়নি।

অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, সেই প্রকল্প বর্তমানে চালু নেই। তবে এর চেয়েও চরম সত্য হচ্ছে, গবেষণায় বরাদ্দ একদম কম। গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না দেওয়া হলে ভালো ও উঁচুমানের গবেষণা করা সম্ভব নয়। এখান-ওখান থেকে নিয়ে গবেষণা করা যায়। কিন্তু সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘অ্যাপ্লাইড রিসার্চ’ (ব্যবহারিক গবেষণা) হয়। মৌলিক গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ হওয়া দরকার। পাশাপাশি শিক্ষকরা যাতে গবেষণায় উৎসাহী ও নিয়োজিত হন সে ধরনের প্রয়োজনীয় সংস্কারও করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, তবে হতাশার মধ্যে আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় থেকে এই খাতে বাজেট রাখা হচ্ছে। গবেষকরা সেখান থেকে তহবিল পাচ্ছেন। এটা শুভ উদ্যোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২০-২৫ কোটি টাকার তহবিল পাওয়া গেছে। এজন্য উদ্যোগী শিক্ষক ও গবেষকদের কাছ থেকে প্রকল্প প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। সোমবার প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর মূল্যায়ন বৈঠকে আমিও ছিলাম। অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব এসেছে। এর মানে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষকেরা চিন্তা করেন। তারা চাইলে ভালো কিছু করতে পারবেন। এটাই আমাকে আশাবাদী করছে।

তিনি আরও বলেন, তার পরও বলা যায়, বর্তমানে গবেষণায় যে বরাদ্দ আছে তা যথেষ্ট নয়। আমার অনুরোধ থাকবে, এ ধরনের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া) বরাদ্দ যেন অব্যাহত থাকে। তা ‘ওয়ান-টাইম’ যেন না হয়। আমরা বর্তমানে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেট করছি। দেশ যে সমৃদ্ধ হয়েছে এটা তার বড় প্রমাণ। এমন অর্থনীতির দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বাজেটের বাইরে কেবল গবেষণায় বড় ধরনের বরাদ্দ রাখা সম্ভব। টেকসই ও স্থায়ী (ভায়াবল) গবেষণার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখতে সক্ষম। অর্থনীতির পাশাপাশি মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টিতেও আমরা সমৃদ্ধিশালী হতে চাই। গবেষণায় আলাদা বাজেট দেওয়া হলে এর ‘রিটার্ন’ (ইতিবাচক ফল) দেশ অবশ্যই পাবে। তা ছাড়া বৈশ্বিকভাবে আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (এসডিজি) নিয়ে এগোচ্ছি। দেশের টেকসই উন্নয়ন এবং উন্নত দেশের আসনে উন্নীত হতে গবেষণায় বরাদ্দের বিকল্প নেই।
অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জ্ঞানগত দিকে নয় উন্নতি হচ্ছে বস্তুগতভাবে
-ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বরেণ্য শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষণা সমার্থক শব্দ। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল স্নাতক আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানের জন্য নয়। গবেষণার জন্যই স্নাতক-স্নাতকোত্তর স্তরে শিক্ষার্থী নেয়া হয়ে থাকে, যাদের একটি অংশ পরবর্তীকালে গবেষণায় নিয়োজিত হবেন। তারা এমফিল-পিএইচডি গবেষণা করবেন। জ্ঞানের নতুন নতুন দিক 

উন্মোচিত করবেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয় মানেই হলো গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা নির্ণীত হয় গবেষণা ও প্রকাশনা দ্বারা; কতসংখ্যক ডিগ্রি দিল সেটা দিয়ে নয়।

তিনি বলেন, গবেষণা কেবল শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষকরাও করবেন। তারা সামষ্টিকভাবে জাতিকে জ্ঞানগতভাবে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন। জ্ঞানগত সচ্ছলতার দিকে এগিয়ে নেবেন তারা। একজন নবীন গ্রাজুয়েট যখন পেশায় আসবেন তখন তিনি তার পূর্বসূরিকে দেখে উৎসাহিত হবেন। উত্তরসূরির এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্বটা হচ্ছে তিনি গবেষণা করবেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে দৃষ্টান্ত করবেন।

অধ্যাপক চৌধুরীর মতে, গবেষণার জন্য শিক্ষকদের আগ্রহ থাকতে হবে। এটা দুইভাবে করা যায়। একটি হচ্ছে, মর্যাদা বাড়িয়ে। আরেকটি হচ্ছে, তার পেশাগত জীবনে এর জন্য আলাদা মূল্যায়ন থাকবে। পদোন্নতিতে পিএইচডি ডিগ্রির প্রয়োজন আছে কি না। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে পদায়নের জন্য উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা কিংবা প্রকাশনার কতটা গুরুত্ব আছে। এসব হচ্ছে মর্যাদার দৃষ্টান্ত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসবের বিবেচনা নেই। এর মানে হচ্ছে, পিএইচডি বা গবেষণার মর্যাদা নেই। গবেষণা বিমুখতা এটাই প্রমাণ করে। সমাজের প্রতিফলন পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়েও।

তিনি বলেন, আমরা বস্তুগতভাবে অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু জ্ঞানগত দিক থেকে উন্নতি হচ্ছে না। এর কারণ আছে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলেও গবেষণার মর্যাদা নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় কি শিক্ষকের বা তার মতামতের প্রয়োজন হয়? সমাজইবা কতটা মর্যাদা দেয়! আসলে গোটা ব্যবস্থাই জ্ঞানবিরোধী একটা অবস্থায় আছে।

আসলে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় ও বৃহত্তর সামাজিক ব্যবস্থারই অংশ। এরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকে এটা আমাদেরকে পথ দেখাবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় সেটা পারছে না। অন্য দিকে সমাজে সবকিছু পণ্যে পরিণত হয়েছে। সবকিছু আর্থিক মূল্যে বিচার করা হয়। গবেষণার ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি বিবেচনা পায়। তাই, এখন শিক্ষকদের মধ্যে অনেককে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী দেখা যায়। নিজ কর্মস্থলের পরে অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। এসবই দুঃখজনক ব্যাপার।

এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ বলেন, আমি শিক্ষকদের শাস্তি দেওয়ার পক্ষে নই। গবেষণায় তাদের উদ্বুদ্ধ করা যাবে না। এটা দুইভাবে করা যায়। প্রথমত, তাদের শাস্তির ভয় না দেখিয়ে উৎসাহিত করার কৌশল নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত সম্মান বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়টি বেশি জরুরি।

একজন শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রি করার পর তার মর্যাদা কী হলো আর অধিকসংখ্যক পিএইচডি তত্ত্বাবধান করলে একজন শিক্ষকের মর্যাদাগত কী বিবেচনা তিনি পেলেন-সেটা জরুরি। তিনি বলেন, গবেষণায় তহবিল আর পরিবেশও একটা বড় বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল থাকবে। এই সংখ্যা যত বেশি থাকবে তত মঙ্গল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থা থাকবে। সেখানে প্রকাশনা প্রকাশিত হবে। এভাবে গবেষণার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আরেকটি কাজ হচ্ছে অনুবাদ। এটা করলে একদিকে তিনি সমৃদ্ধ হবেন এবং কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকলে তা দূর হবে।

পাশাপাশি তার এই অনুবাদ থেকে ছাত্রছাত্রী ও সার্বিকভাবে জনগণ উপকৃত হবেন। এ দিকেও তারা গুরুত্ব দিতে পারেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের গ্রহণ ও প্রকাশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এদিকেও দুর্বলতা বিরাজমান আছে। গবেষণার পাশাপাশি এদিকেও তারা গুরুত্ব দিতে পারেন।

তিনি বলেন, একটা লজ্জাজনক ব্যাপার হচ্ছে, গবেষণায় বরাদ্দ অপ্রতুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দের বেশির ভাগ বেতনভাতাসহ আনুষঙ্গিক খাতে চলে যায়। গবেষণার জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে, বরাদ্দ কম হলেও বেসরকারি উৎস বিশেষ করে অ্যালামনাইসহ অন্য খাত থেকে অনুদান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট সমৃদ্ধ করা যায়। এজন্য প্রথম কাজ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেকেই গবেষণা দিয়ে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে, অনেকে টাকা দিতে চান। কিন্তু আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পরিচয় তুলে ধরতে পারিনি।

বর্তমানে কিছু ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের রেওয়াজ চালু আছে। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান আর লেকচারের ব্যবস্থা আছে। গবেষণা চেয়ার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্তও আছে। এই ব্যবস্থায় অবশ্য কিছু উপকার হয়। তবে সার্বিকভাবে গবেষণার জন্য তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। এই কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিজের কাজ দিয়ে করতে হবে। গবেষণা হলে তহবিল আসবে। এই দায়িত্বটা পালন করতে হবে শিক্ষককেই। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি প্রকাশ পাবে।
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্বলতা আছে গবেষণা কর্মে 
-ড. এএসএম মাকসুদ কামাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, গবেষণা, শিক্ষণ ও গবেষণা-শিক্ষণ সংমিশ্রণে সাধারণত তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একটিও গড়ে ওঠেনি। কিছু শিক্ষণ বা ডিগ্রি প্রদানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আচরণ করছে। আর কিছু গবেষণা-শিক্ষণ উভয় চরিত্র নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য। আর কলেজ নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য নয়। বিদ্যমান জ্ঞানের আলোকে শিক্ষার্থী প্রস্তুত করে দেয় কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নতুন সৃষ্টির কাজে লাগায়।

তবে এটাও ঠিক যে, গবেষণা কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্বলতাও আছে। অনেক শিক্ষক আছেন যারা গবেষণা প্রস্তাবটি পর্যন্ত ঠিকমতো লিখতে পারেন না। এটা হওয়ার কারণ হচ্ছে, শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর অনেকেই পিএইচডি আর পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন না। এখন গবেষণা না করলে এসব তো কারও জানার কথা নয়।

গবেষণা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। সেক্ষেত্রে তাকে কেবল অ্যাসিস্ট্যান্ট লেকচারার হিসেবে থাকতে হয়। আর আমরা ভালো ফল করা একজন নবীন গ্রাজুয়েটকে নিয়োগ দিই। আবার এ ধরনের শিক্ষকদের অনেকেই বর্তমানে দেশের বাইরে গিয়ে ডিগ্রি করার ব্যাপারে আগ্রহী নন। যে কারণে দুই-তৃতীয়াংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি নেই। এমনটা হয়েছে আমাদের নিয়োগ আর পদোন্নতি নীতিমালার দুর্বলতার কারণে। এটির পাশাপাশি অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করা প্রয়োজন। বিপরীত দিকে এটাও ঠিক যে, ১০ হাজার ‘সাইটেশন’ (গবেষণা) আছে এমন বেশকিছু অধ্যাপক পাওয়া যাবে দেশে। ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালে’ (মানসম্মত প্রকাশনা প্রকাশের জন্য বৈশ্বিকভাবে সমাদৃত) গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে এমন শিক্ষক অনেক আছেন। প্রচারের অভাব, ওয়েবসাইটের দুর্বলতা এবং সৃষ্ট জ্ঞান জাতীয়ভাবে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা না থাকায় সেসব মানুষ জানছে না। পাশাপাশি এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পিছিয়ে যাচ্ছে।

আরেকটি দিক হচ্ছে, গবেষণার পরিবেশ ও সুযোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ওভারসিজ স্কলারশিপের মাধ্যমে শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে। জাতীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রী গবেষণা তহবিল আছে। কিন্তু সেখানে শিক্ষকদের অংশ খুবই কম। শিক্ষকদেরই মূলত উচ্চশিক্ষা আর বৈশ্বিক পর্যায়ে অবগাহন করা দরকার। যার শ্রেণিকক্ষে যেতে হয় না তাকে যদি এ ক্ষেত্রে রাখা হয় তাহলে সেটা কত যৌক্তিক তাও ভাবনার সময় এসেছে। শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরও কমে যাচ্ছে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ আগের চেয়ে সংখ্যা কমেছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া সম্পন্ন হলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরও কমবে। এসব কারণে যার প্রকৃত অর্থে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য উচ্চশিক্ষা দরকার তার পেছনে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।

সরকারের আর্থিক সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দও বাড়ছে। শতবর্ষ উপলক্ষে কেবল গবেষণার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গবেষণা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আমরা আরও সাড়ে ৪শ কোটি টাকা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আসলে সরকারের কাছে টাকা চাইতে হবে এবং চাওয়ার মতো অবস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আমরা সেটা পারিনি বলে বরাদ্দ পাচ্ছি না। এজন্য সরকারকে দায়ী করা সমীচীন নয়।

বাংলাদেশে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত চারটি, বুয়েট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিকেন্দ্রিক লেখাপড়ার পাশাপাশি গবেষণায়ও ভূমিকা রাখছে। আমরা অনেকেই খোঁজ রাখি না বলে তা জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকেও (সোমবার) দেড় শতাধিক গবেষণা প্রকল্প নিয়ে মূল্যায়ন বৈঠক হয়েছে। দেশের সিনিয়র অধ্যাপকরা তা মূল্যায়ন করেছেন। এখান থেকে নির্বাচিতরা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবেন গবেষণা কাজে। 
অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল
প্রোভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়