০৩:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

‘গোল্ডেন মনিরে’র ছিল ভিআইপি সমাদর

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:২৩:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ নভেম্বর ২০২০
  • / ৪১৭৯ বার দেখা হয়েছে

রাজধানীর বাড্ডার ইউলুপটি উদ্বোধন করা হয় ২০১৮ সালে। ওই অনুষ্ঠানে ভিআইপি অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত ‘রেড জোনে’ বসার আমন্ত্রণ পান মনির হোসেন ওরফে ‘গোল্ডেন মনির’। সরকারি এ অনুষ্ঠানে ভিআইপি জোনে মনিরের আসন দেখে তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা বিস্মিতও হন। পরে তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রাউজকের কর্মকর্তারাই  তাকে ভিআইপি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। গতকাল রোববার সরকারদলীয় একজন নেতা সমকালের কাছে ওই ঘটনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে প্রশাসনের অসাধু চক্রে গোল্ডেন মনিরের প্রভাব নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ওই নেতা জানান, এ রকম আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ভিআইপি সমাদরই পেয়েছেন মনির।

অথচ নব্বইয়ের দশকেও মনির ছিলেন কাপড়ের দোকানের এক সাধারণ বিক্রয়কর্মী। পরে জড়ান স্বর্ণ চোরাচালানে। অল্প দিনেই চোরাকারবারিদের মূল হোতা হয়ে ওঠেন তিনি। বিভিন্ন সময় চোরাকারবারি হিসেবে তার সহচরদের নাম আলোচনায় এলেও নিজেকে একপ্রকার আড়ালেই রাখতে সক্ষম হন মনির। আরও চমকপ্রদ হলো, বাড্ডা এলাকায় বড় ‘দানবীর’ হিসেবেই পরিচিতি ছিল তার।

এমনকি ‘বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন একাধিক বিদ্যায়তনও। শুক্রবার রাতে রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মনিরকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল রোববার তিন মামলায় তাকে ১৮ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এখন তার সহযোগীদের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সমকালকে বলেন, গোল্ডেন মনিরের মতো স্বর্ণ চোরাচালানের ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত অব্যাহত থাকবে। মনির একজন ভূমিদস্যুও। আশা করি রাজউক তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেবে। এরই মধ্যে রাজউকের কিছু পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ ছাড়া মনিরের বিদেশে টাকা পাচার করার তথ্যও পাওয়া গেছে।

পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, মনিরের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যদেরও বের করা হবে।

স্বর্ণ চোরাচালানে পাঁচ রাঘববোয়াল: স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে মনির হয়ে ওঠেন ‘গোল্ডেন মনির’। এই সিন্ডিকেটে তার বিশ্বস্ত কয়েকজন ছিলেন। তারাও অল্প দিনে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মনিরের সিন্ডিকেটে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন রিয়াজ উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, সালেহ আহমেদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল ওরফে সোনা শফিক ও সাবেক কাউন্সিলর কাইয়ুম। তাদের মধ্যে রিয়াজ উদ্দিন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ সালের আগস্টে রিয়াজকে গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর দেড় মণের বেশি স্বর্ণ ও তিন কোটি ২৯ লাখ টাকা মূল্যের সৌদি রিয়াল উদ্ধার করে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিল স্বর্ণ চোরাকারবারি মোহাম্মদ আলী। তার তথ্যের ভিত্তিতে রিয়াজের নামটি সামনে আসে। পরে একই সিন্ডিকেটের সদস্য ধনকুবের সালেহ আহমেদের নামও বেরিয়ে আসে।

গুলশান-১-এর সিটি করপোরেশন মার্কেটের প্রথম তলায় আশিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রসাধনীর দোকান রয়েছে সালেহ আহমেদের। কোটি টাকা মূল্যের প্রাডো গাড়িসহ একাধিক গাড়িও রয়েছে তার। গুলশান এক নম্বর সেকশনে ২৩/বি নম্বর সড়কে আছে বিলাসবহুল বাড়ি। সালেহের একাধিক বাড়ি আছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায়। পরস্পর যোগসাজশে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত হয়েই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে জানান, স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় এই সিন্ডিকেটের বিমানবন্দরকেন্দ্রিক বড় চক্র রয়েছে। তবে অনেক সময় চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও গোল্ডেন মনিরের নামটি তারা প্রকাশ করতেন না। এর ফলে মনির নানা জায়গা ম্যানেজ করে কারবার চালিয়ে নিতেন। আবার সহযোগীদের ছাড়িয়ে আনতেও দেনদরবার করতেন। এ ব্যাপারে জানতে রিয়াজ উদ্দিনের ফোনে কথা বলার চেষ্টা করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। কাউন্সিলর শফিকুলও ফোন ধরেননি।

রাজউক ও গণপূর্তে প্রভাববলয়: একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনিরের সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল রাজউক ও গণপূর্তে। একাধিক দেহরক্ষী নিয়ে তিনি প্রায়ই দুই প্রতিষ্ঠানে যেতেন। গেটে নামলেই তাকে ভিআইপি প্রটোকল দিয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বড় কর্তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন তিনি।

প্রভাবশালীদের সঙ্গে সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অনেককে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ার পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল মনিরের। জালিয়াতি করে ২০০-এর বেশি প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। রাজউকের বাড্ডা পুনর্বাসন জোনের শতাধিক প্লট তার প্রভাববলয়ে রয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রাজউকের গুরুত্বপূর্ণ নথি জাল করতেন তিনি। রাজউকের অঘোষিত হর্তাকর্তা হয়ে উঠেছিলেন মনির। প্রতিষ্ঠানটির এনেক্স ভবনের ৫ তলার ৫১৪ নম্বর কক্ষটি ভাড়া নিয়ে নিজের অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন একসময়।

তবে অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য থাকলেও গত বছর ওই কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ৭১টি ফাইল জব্দ করা হয়। মনিরের সহযোগী রাজউকের কর্মচারী পারভেজকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় দায়ের করা ওই মামলায় মনির ‘পলাতক’ ছিলেন। যদিও তিনি প্রকাশ্যেই সব কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অনেক অসাধু কর্মকর্তাকে দামি উপহার ও অর্থ সুবিধা দিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নিতেন মনির। একজন মন্ত্রীকে মনিরের দামি গাড়ি উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অনেক কর্মকর্তাকে নিজের টাকায় প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণে পাঠাতেন। রাজউকের অনেক কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রায় বৃহস্পতিবার সৌদি আরব যেতেন। শুক্রবার সেখানে অবস্থান করে আবার শনিবার দেশে ফেরত আসতেন।

বিদেশে টাকা পাচার: তদন্ত সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনির বিদেশে টাকা পাচার করতেন। যাদের কাছে টাকা পাঠাতেন তাদের মধ্যে কিছু নামও এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান চলছে। যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে টাকা পাঠাতেন মনির। শিগগিরই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি মনিরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করবে।

সেই বাড়িতে ঝুলছে তালা: গতকাল রোববার মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়- ১১ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর ছয়তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়িটির প্রধান গেট ভেতর থেকে তালাবদ্ধ। কয়েকবার ডাকাডাকির পর দারোয়ান আবু তাহের পকেট গেট খুলে ভেতর থেকেই কথা বলেন। তিনি জানালেন, গোল্ডেন মনিরকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর শনিবার দুই সন্তান নিয়ে তার স্ত্রী বাসা থেকে বেরিয়ে যান। কোথায় গেছেন তা তিনি জানেন না। বাড়িটি তিনিই দেখাশোনা করছেন।

তাহের জানান, ছয়তলা বাড়িটির মাত্র ছয়তলার ফ্লোরটি এক ব্যবসায়ীকে ভাড়া দেওয়া আছে। দোতলা ও তিনতলা ডুপ্লেক্স। মনির পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ডুপ্লেক্সে। বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকা দুটি প্রাডো গাড়ি সম্পর্কে তাহের বলেন, এ দুটি মনিরের শোরুমের গাড়ি। মাঝে মধ্যেই শোরুমের গাড়ি সেখানে রাখা হয় বলে জানান তিনি।

‘দানবীর’ মনির: ডিআইটি প্রজেক্ট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি গোল্ডেন মনির এলাকায় ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচিত। মানুষের ‘বিপদে আপদে’ হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। করোনা মহামারির শুরুর দিকে দেড় মাস ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। ডিআইটি প্রজেক্টের ১০ নম্বর সড়কে বাবা সিরাজ মিয়ার নামে ‘সিরাজ মিয়া মেমোরিয়াল স্কুল’ এবং ৯ নম্বর সড়কে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। এ ছাড়া মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করেন দু’হাত খুলে।

স্থানীয় কয়েকজন জানান, যে জমিতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেটি সরকারি জায়গা। সবাই তাকে ‘দানবীর’ মনির হিসেবে জানলেও প্রবীণ দু-একজন তার নেপথ্য কাহিনিও জানতেন আগে থেকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বৃদ্ধ অভিন্ন ভাষায় জানান, তারা শুনেছেন মনির একসময় স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন বড় ব্যবসায়ী বনে গেছেন। এ ছাড়া নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা উপার্জন করেন তিনি। এক হাতে অবৈধভাবে টাকা কামান, আরেক হাতে দান করেন।

স্থানীয় এক যুবক জানান, ওই সড়কের স্থায়ী বাসিন্দা তিনি। এতদিন মনিরকে ‘দানবীর’ হিসেবে চিনতেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর মনিরের আরেক ‘জগৎ’ সম্পর্কে জানতে পারলেন তিনি। তিনি বলেন, এলাকাবাসী হিসেবে একাধিকবার মনিরের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। ভালো আচরণ করতেন সবার সঙ্গে। কিন্তু এই মানুষটি যে একজন স্বর্ণ চোরাকারবারি ও জালজালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত, তা ভাবতেও পারেননি এতদিন। র‌্যাব তাকে না ধরলে নেপথ্যের মনিরকে জানা হতো না কখনোই।

স্থানীয়রা জানান, সরকারদলীয় একাধিক এমপি ও বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে মনিরের সখ্য ছিল। এ কারণে এলাকার লোকজন তাকে সমীহ করে চলতেন। যদিও এক সময় মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন গোল্ডেন মনির।

তিন মামলা: মনিরের বিরুদ্ধে গতকাল রোববার র‌্যাব বাড্ডা থানায় তিনটি মামলা করেছে। একটি বিশেষ ক্ষমতা আইনে, একটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এবং অপরটি অস্ত্র মামলা। তিন মামলারই বাদী র‌্যাব। বাড্ডা থানার ওসি পারভেজ ইসলাম মামলা রুজুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

একটি মামলার এজাহারের একাংশে বলা হয়েছে- রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান থাকাকালে চোরাকারবারিদের সঙ্গে মনিরের পরিচয় ঘটে। এরপর শুরু করে লাগেজ ব্যবসা। পরে স্বর্ণ চোরাকারবারিতে নাম লেখান মনির। স্বর্ণ চোরাচালানে ‘সফলতা’ আসায় মনিরের নামের আগে ‘গোল্ডেন’ পদবি দেন ব্যবসায়ীরা। এরপর থেকেই গোল্ডেন মনির নামে পরিচিত তিনি। মনির স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে প্রচুর টাকার মালিক হন। পরে ভূমি জালিয়াতি ব্যবসায় নামেন তিনি। ভূমি জালিয়াতির ঘটনায় গত বছর মতিঝিল থানায় মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে তার বিরুদ্ধে ২০১২ সালে রমনা মডেল থানায় মামলা হয়।

এক ভবনেই ৫০০ কোটি টাকার মালিকানা: রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ মোড়ের ২০ কাঠা আয়তনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ‘জমজম টাওয়ার’। ১৪ তলা টাওয়ারের চারজন মালিকের একজন মনির। মনিরসহ এই টাওয়ারের চার মালিকই বিতর্কিত বলে জানা গেছে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে এই টাওয়ার নির্মাণ করেন তারা।

এই টাওয়ারের মালিকদের একজন ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ওরফে সোনা শফিক। শফিক ৯০ দশকে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকায় হকারি করতেন। পরে মনির ও শফিক স্বর্ণ চোরাকারবারি শুরু করেন। স্বর্ণ চোরাকারবারিতে ‘সফলতা’ আসায় মনির যেমন ‘গোল্ডেন মনির’ হয়ে ওঠেন, একইভাবে শফিকুলও ‘সোনা শফিক’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরে গোল্ডেন মনির ও সোনা শফিকসহ চারজন উত্তরায় জমজম টাওয়ার নির্মাণ করেন। এ টাওয়ারে মনিরের মালিকানার বর্তমান মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। অন্য মালিকরা হলেন- স্বর্ণ চোরাচালানে অভিযুক্ত সিরাজগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন এবং হায়দার। হায়দারের বাড়িও সিরাজগঞ্জে।

কাইয়ুমের সম্পদ দেখভাল করতেন মনির: নামে-বেনামে নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ রয়েছে গোল্ডেন মনিরের। তার মালিকানায় রয়েছে মনির বিল্ডার্স ও গার্লস অটোকারস লিমিটেড। স্বদেশ প্রপার্টিজেরও অন্যতম পরিচালক তিনি। বিএনপি সমর্থক সাবেক কমিশনার এম এ কাইয়ুম দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে পলাতক রয়েছেন। দেশ ছাড়ার আগে কাইয়ুমের অনেক সম্পদ দেখভাল করতে গোল্ডেন মনিরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ব্যাংকে জমা ৯৩০ কোটি টাকা: জানা গেছে, এখন পর্যন্ত গোল্ডেন মনিরের চারটি ব্যাংকের ২৫টি হিসাব নম্বর পাওয়া গেছে। সেখানে গতকাল পর্যন্ত তার জমা ছিল ৯৩০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে তার ঋণ রয়েছে ১১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গোল্ডেন মনিরের সম্পদের পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।

শেয়ার করুন

x
English Version

‘গোল্ডেন মনিরে’র ছিল ভিআইপি সমাদর

আপডেট: ১১:২৩:৫৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ নভেম্বর ২০২০

রাজধানীর বাড্ডার ইউলুপটি উদ্বোধন করা হয় ২০১৮ সালে। ওই অনুষ্ঠানে ভিআইপি অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত ‘রেড জোনে’ বসার আমন্ত্রণ পান মনির হোসেন ওরফে ‘গোল্ডেন মনির’। সরকারি এ অনুষ্ঠানে ভিআইপি জোনে মনিরের আসন দেখে তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা বিস্মিতও হন। পরে তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রাউজকের কর্মকর্তারাই  তাকে ভিআইপি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। গতকাল রোববার সরকারদলীয় একজন নেতা সমকালের কাছে ওই ঘটনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে প্রশাসনের অসাধু চক্রে গোল্ডেন মনিরের প্রভাব নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ওই নেতা জানান, এ রকম আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ভিআইপি সমাদরই পেয়েছেন মনির।

অথচ নব্বইয়ের দশকেও মনির ছিলেন কাপড়ের দোকানের এক সাধারণ বিক্রয়কর্মী। পরে জড়ান স্বর্ণ চোরাচালানে। অল্প দিনেই চোরাকারবারিদের মূল হোতা হয়ে ওঠেন তিনি। বিভিন্ন সময় চোরাকারবারি হিসেবে তার সহচরদের নাম আলোচনায় এলেও নিজেকে একপ্রকার আড়ালেই রাখতে সক্ষম হন মনির। আরও চমকপ্রদ হলো, বাড্ডা এলাকায় বড় ‘দানবীর’ হিসেবেই পরিচিতি ছিল তার।

এমনকি ‘বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন একাধিক বিদ্যায়তনও। শুক্রবার রাতে রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মনিরকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল রোববার তিন মামলায় তাকে ১৮ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এখন তার সহযোগীদের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছেন গোয়েন্দারা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সমকালকে বলেন, গোল্ডেন মনিরের মতো স্বর্ণ চোরাচালানের ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত অব্যাহত থাকবে। মনির একজন ভূমিদস্যুও। আশা করি রাজউক তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেবে। এরই মধ্যে রাজউকের কিছু পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ ছাড়া মনিরের বিদেশে টাকা পাচার করার তথ্যও পাওয়া গেছে।

পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, মনিরের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যদেরও বের করা হবে।

স্বর্ণ চোরাচালানে পাঁচ রাঘববোয়াল: স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে মনির হয়ে ওঠেন ‘গোল্ডেন মনির’। এই সিন্ডিকেটে তার বিশ্বস্ত কয়েকজন ছিলেন। তারাও অল্প দিনে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মনিরের সিন্ডিকেটে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন রিয়াজ উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, সালেহ আহমেদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল ওরফে সোনা শফিক ও সাবেক কাউন্সিলর কাইয়ুম। তাদের মধ্যে রিয়াজ উদ্দিন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ সালের আগস্টে রিয়াজকে গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর দেড় মণের বেশি স্বর্ণ ও তিন কোটি ২৯ লাখ টাকা মূল্যের সৌদি রিয়াল উদ্ধার করে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিল স্বর্ণ চোরাকারবারি মোহাম্মদ আলী। তার তথ্যের ভিত্তিতে রিয়াজের নামটি সামনে আসে। পরে একই সিন্ডিকেটের সদস্য ধনকুবের সালেহ আহমেদের নামও বেরিয়ে আসে।

গুলশান-১-এর সিটি করপোরেশন মার্কেটের প্রথম তলায় আশিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রসাধনীর দোকান রয়েছে সালেহ আহমেদের। কোটি টাকা মূল্যের প্রাডো গাড়িসহ একাধিক গাড়িও রয়েছে তার। গুলশান এক নম্বর সেকশনে ২৩/বি নম্বর সড়কে আছে বিলাসবহুল বাড়ি। সালেহের একাধিক বাড়ি আছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায়। পরস্পর যোগসাজশে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত হয়েই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে জানান, স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় এই সিন্ডিকেটের বিমানবন্দরকেন্দ্রিক বড় চক্র রয়েছে। তবে অনেক সময় চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও গোল্ডেন মনিরের নামটি তারা প্রকাশ করতেন না। এর ফলে মনির নানা জায়গা ম্যানেজ করে কারবার চালিয়ে নিতেন। আবার সহযোগীদের ছাড়িয়ে আনতেও দেনদরবার করতেন। এ ব্যাপারে জানতে রিয়াজ উদ্দিনের ফোনে কথা বলার চেষ্টা করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। কাউন্সিলর শফিকুলও ফোন ধরেননি।

রাজউক ও গণপূর্তে প্রভাববলয়: একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনিরের সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল রাজউক ও গণপূর্তে। একাধিক দেহরক্ষী নিয়ে তিনি প্রায়ই দুই প্রতিষ্ঠানে যেতেন। গেটে নামলেই তাকে ভিআইপি প্রটোকল দিয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বড় কর্তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন তিনি।

প্রভাবশালীদের সঙ্গে সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অনেককে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ার পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল মনিরের। জালিয়াতি করে ২০০-এর বেশি প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। রাজউকের বাড্ডা পুনর্বাসন জোনের শতাধিক প্লট তার প্রভাববলয়ে রয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রাজউকের গুরুত্বপূর্ণ নথি জাল করতেন তিনি। রাজউকের অঘোষিত হর্তাকর্তা হয়ে উঠেছিলেন মনির। প্রতিষ্ঠানটির এনেক্স ভবনের ৫ তলার ৫১৪ নম্বর কক্ষটি ভাড়া নিয়ে নিজের অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন একসময়।

তবে অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য থাকলেও গত বছর ওই কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ৭১টি ফাইল জব্দ করা হয়। মনিরের সহযোগী রাজউকের কর্মচারী পারভেজকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় দায়ের করা ওই মামলায় মনির ‘পলাতক’ ছিলেন। যদিও তিনি প্রকাশ্যেই সব কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অনেক অসাধু কর্মকর্তাকে দামি উপহার ও অর্থ সুবিধা দিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নিতেন মনির। একজন মন্ত্রীকে মনিরের দামি গাড়ি উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অনেক কর্মকর্তাকে নিজের টাকায় প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণে পাঠাতেন। রাজউকের অনেক কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রায় বৃহস্পতিবার সৌদি আরব যেতেন। শুক্রবার সেখানে অবস্থান করে আবার শনিবার দেশে ফেরত আসতেন।

বিদেশে টাকা পাচার: তদন্ত সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনির বিদেশে টাকা পাচার করতেন। যাদের কাছে টাকা পাঠাতেন তাদের মধ্যে কিছু নামও এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান চলছে। যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে টাকা পাঠাতেন মনির। শিগগিরই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি মনিরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করবে।

সেই বাড়িতে ঝুলছে তালা: গতকাল রোববার মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়- ১১ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর ছয়তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়িটির প্রধান গেট ভেতর থেকে তালাবদ্ধ। কয়েকবার ডাকাডাকির পর দারোয়ান আবু তাহের পকেট গেট খুলে ভেতর থেকেই কথা বলেন। তিনি জানালেন, গোল্ডেন মনিরকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর শনিবার দুই সন্তান নিয়ে তার স্ত্রী বাসা থেকে বেরিয়ে যান। কোথায় গেছেন তা তিনি জানেন না। বাড়িটি তিনিই দেখাশোনা করছেন।

তাহের জানান, ছয়তলা বাড়িটির মাত্র ছয়তলার ফ্লোরটি এক ব্যবসায়ীকে ভাড়া দেওয়া আছে। দোতলা ও তিনতলা ডুপ্লেক্স। মনির পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ডুপ্লেক্সে। বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকা দুটি প্রাডো গাড়ি সম্পর্কে তাহের বলেন, এ দুটি মনিরের শোরুমের গাড়ি। মাঝে মধ্যেই শোরুমের গাড়ি সেখানে রাখা হয় বলে জানান তিনি।

‘দানবীর’ মনির: ডিআইটি প্রজেক্ট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি গোল্ডেন মনির এলাকায় ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচিত। মানুষের ‘বিপদে আপদে’ হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। করোনা মহামারির শুরুর দিকে দেড় মাস ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। ডিআইটি প্রজেক্টের ১০ নম্বর সড়কে বাবা সিরাজ মিয়ার নামে ‘সিরাজ মিয়া মেমোরিয়াল স্কুল’ এবং ৯ নম্বর সড়কে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। এ ছাড়া মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করেন দু’হাত খুলে।

স্থানীয় কয়েকজন জানান, যে জমিতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেটি সরকারি জায়গা। সবাই তাকে ‘দানবীর’ মনির হিসেবে জানলেও প্রবীণ দু-একজন তার নেপথ্য কাহিনিও জানতেন আগে থেকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বৃদ্ধ অভিন্ন ভাষায় জানান, তারা শুনেছেন মনির একসময় স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন বড় ব্যবসায়ী বনে গেছেন। এ ছাড়া নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা উপার্জন করেন তিনি। এক হাতে অবৈধভাবে টাকা কামান, আরেক হাতে দান করেন।

স্থানীয় এক যুবক জানান, ওই সড়কের স্থায়ী বাসিন্দা তিনি। এতদিন মনিরকে ‘দানবীর’ হিসেবে চিনতেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর মনিরের আরেক ‘জগৎ’ সম্পর্কে জানতে পারলেন তিনি। তিনি বলেন, এলাকাবাসী হিসেবে একাধিকবার মনিরের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। ভালো আচরণ করতেন সবার সঙ্গে। কিন্তু এই মানুষটি যে একজন স্বর্ণ চোরাকারবারি ও জালজালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত, তা ভাবতেও পারেননি এতদিন। র‌্যাব তাকে না ধরলে নেপথ্যের মনিরকে জানা হতো না কখনোই।

স্থানীয়রা জানান, সরকারদলীয় একাধিক এমপি ও বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে মনিরের সখ্য ছিল। এ কারণে এলাকার লোকজন তাকে সমীহ করে চলতেন। যদিও এক সময় মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন গোল্ডেন মনির।

তিন মামলা: মনিরের বিরুদ্ধে গতকাল রোববার র‌্যাব বাড্ডা থানায় তিনটি মামলা করেছে। একটি বিশেষ ক্ষমতা আইনে, একটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এবং অপরটি অস্ত্র মামলা। তিন মামলারই বাদী র‌্যাব। বাড্ডা থানার ওসি পারভেজ ইসলাম মামলা রুজুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

একটি মামলার এজাহারের একাংশে বলা হয়েছে- রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান থাকাকালে চোরাকারবারিদের সঙ্গে মনিরের পরিচয় ঘটে। এরপর শুরু করে লাগেজ ব্যবসা। পরে স্বর্ণ চোরাকারবারিতে নাম লেখান মনির। স্বর্ণ চোরাচালানে ‘সফলতা’ আসায় মনিরের নামের আগে ‘গোল্ডেন’ পদবি দেন ব্যবসায়ীরা। এরপর থেকেই গোল্ডেন মনির নামে পরিচিত তিনি। মনির স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে প্রচুর টাকার মালিক হন। পরে ভূমি জালিয়াতি ব্যবসায় নামেন তিনি। ভূমি জালিয়াতির ঘটনায় গত বছর মতিঝিল থানায় মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে তার বিরুদ্ধে ২০১২ সালে রমনা মডেল থানায় মামলা হয়।

এক ভবনেই ৫০০ কোটি টাকার মালিকানা: রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ মোড়ের ২০ কাঠা আয়তনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ‘জমজম টাওয়ার’। ১৪ তলা টাওয়ারের চারজন মালিকের একজন মনির। মনিরসহ এই টাওয়ারের চার মালিকই বিতর্কিত বলে জানা গেছে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে এই টাওয়ার নির্মাণ করেন তারা।

এই টাওয়ারের মালিকদের একজন ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ওরফে সোনা শফিক। শফিক ৯০ দশকে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকায় হকারি করতেন। পরে মনির ও শফিক স্বর্ণ চোরাকারবারি শুরু করেন। স্বর্ণ চোরাকারবারিতে ‘সফলতা’ আসায় মনির যেমন ‘গোল্ডেন মনির’ হয়ে ওঠেন, একইভাবে শফিকুলও ‘সোনা শফিক’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরে গোল্ডেন মনির ও সোনা শফিকসহ চারজন উত্তরায় জমজম টাওয়ার নির্মাণ করেন। এ টাওয়ারে মনিরের মালিকানার বর্তমান মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। অন্য মালিকরা হলেন- স্বর্ণ চোরাচালানে অভিযুক্ত সিরাজগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন এবং হায়দার। হায়দারের বাড়িও সিরাজগঞ্জে।

কাইয়ুমের সম্পদ দেখভাল করতেন মনির: নামে-বেনামে নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ রয়েছে গোল্ডেন মনিরের। তার মালিকানায় রয়েছে মনির বিল্ডার্স ও গার্লস অটোকারস লিমিটেড। স্বদেশ প্রপার্টিজেরও অন্যতম পরিচালক তিনি। বিএনপি সমর্থক সাবেক কমিশনার এম এ কাইয়ুম দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে পলাতক রয়েছেন। দেশ ছাড়ার আগে কাইয়ুমের অনেক সম্পদ দেখভাল করতে গোল্ডেন মনিরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ব্যাংকে জমা ৯৩০ কোটি টাকা: জানা গেছে, এখন পর্যন্ত গোল্ডেন মনিরের চারটি ব্যাংকের ২৫টি হিসাব নম্বর পাওয়া গেছে। সেখানে গতকাল পর্যন্ত তার জমা ছিল ৯৩০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে তার ঋণ রয়েছে ১১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গোল্ডেন মনিরের সম্পদের পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।