১০:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

জামানত ছাড়াই নাবিল গ্রুপে ৬৫০০ কোটি টাকার ঋণ!

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১২:১৩:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২
  • / ৪২৮৩ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: বেসরকারি তিন ব্যাংক পর্যাপ্ত নথিপত্র ও জামানত ছাড়াই প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ‘নাবিল গ্রুপ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। যার মধ্যে শুধু ইসলামী ব্যাংকই ঋণ দিয়েছে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা। এ টাকা আইন লঙ্ঘন করে দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এছাড়াও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ২০০ কোটি এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। যা আইন লঙ্ঘন করে দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২১ মার্চ ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা নাবিল ফিড মিলস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয়। ব্যাংকটির গুলশান শাখায় নাবিল গ্রেইন ক্রপসের নামে অনুমোদন দেয়া হয় ৯৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ব্যাংকটি দিচ্ছে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা।

গত ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৪৬তম বোর্ড সভায় নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়।

গত ৩০ মে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ড সভায় গুলশান শাখা থেকে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়।

আইন বলছে, কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ কোনো কোম্পানি বা গ্রুপকে দিতে পারবে না। এই ঋণ ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড উভয় মিলেই। এ ক্ষেত্রে ফান্ডেড বা সরাসরি ঋণ হবে ১৫ শতাংশ, যা বড় ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আগে সুদসহ ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ শতাংশ।

নন-ফান্ডেড ঋণে রপ্তানি খাতের ক্ষেত্রে ১০০ টাকার ঋণকে ৫০ টাকা এবং বিদ্যুৎ খাতের ক্ষেত্রে ১০০ টাকার ঋণকে ২৫ টাকা হিসেবে গণনা করতে হবে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এমন নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

এমতাবস্থায় দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ আইন লঙ্ঘন করেছে। কেননা ব্যাংকটি গত জুন শেষে মোট মূলধনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ হিসেবে ব্যাংকটি একটি গ্রুপকে সর্বোচ্চ দিতে পারবে ২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কিন্তু তারা দিচ্ছে এর চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি।

একই অবস্থা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের। যথাক্রমে ব্যাংক দুইটির মূলধন ছিল তিন হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ও তিন হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংক দু্ইটি নাবিল গ্রুপকে সর্বোচ্চ ঋণ দিতে পারতো  ৯৩০ কোটি ও ৮১৪ কোটি টাকা। কিন্তু দুইটি ব্যাংকই বেশি দিয়েছে ২৭০ কোটি ও ২৯৬ কোটি টাকা টাকা।

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অফ অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ। স্পষ্টতই অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে কিছু বলা হচ্ছে না। তবে নাবিল গ্রুপ দাবি করেছে, তারা নিয়ম মেনেই ঋণ পেয়েছে। নতুন একটি প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হলেও পর্যাপ্ত নথি নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ ঋণেই কোনো ধরনের জামানত রাখা হয়নি। এই ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার হবে তাও পরিষ্কার নয়। এ ছাড়া নতুন একটি গ্রুপকে এত টাকা ঋণ দেয়া হলেও তার পর্যাপ্ত নথি সংরক্ষণ করা হয়নি।

গ্রুপের একটি কোম্পানিকে ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট অনুসারে, এর আগে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ওই কোম্পানির ঋণ রয়েছে মাত্র সাড়ে ৮ লাখ টাকা। ফলে এই পরিমাণ অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে কি না, তাও যাচাই করা হয়নি।

এই ঋণ ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ কি না, সেই সন্দেহ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। বিশেষ নিরীক্ষার সুপারিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, এত বড় অঙ্কের ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেয়া হয়নি। তিন মাসে এলসি কমিশন মাত্র দশমিক ১৫ শতাংশ। গ্যারান্টির ক্ষেত্রে নাবিল ফার্মের করপোরেট গ্যারান্টি গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ড মিটিংয়ে ঋণ অনুমোদন দেয়া হলেও ৪৮২ এবং ৪৮৩তম বোর্ড সভায় শর্ত শিথিল করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গ্যারান্টির ক্ষেত্রে সব পরিচালক এবং তাদের স্বামী/স্ত্রীর গ্যারান্টি ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে শর্ত শিথিল করে শুধু পরিচালকদের গ্যারান্টি রাখা হয়।

আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বলা হয়, নিজ নামে অথবা রেফারেন্সে অন্যদের নামে প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি এবং পরবর্তী সময়ে আমানত ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে, কিন্তু পরে তা শিথিল করে বলা হয়, পর্যাপ্ত আমানত রাখতে হবে। এই পর্যাপ্তের কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, একটি নতুন ঋণের ক্ষেত্রে কোন বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা হলো তা জানা জরুরি। এ ছাড়া গ্রাহক বেনামে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান কি না, সেটিও যাচাই করতে হবে। কোন বিবেচনায় নতুন একজন গ্রাহককে তিন ব্যাংক এত বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তা যাচাই করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে ফোর্সড (বাধ্যতামূলক) ঋণ আদায় অগ্রগতি অবহিত করা, কোন বিবেচনায় এই ঋণ দেয়া হলো, তার ব্যাখ্যা এবং বিস্তারিত কাগজপত্র জমা দেয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলশান শাখার নতুন গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রপসের অনুকূলে ৯৫০ কোটি টাকা নন ফান্ডেড ঋণ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে এই ঋণে ২৩০ কোটি টাকা জামানত হওয়ার কথা। ঋণের শর্তে ১১০ কোটি টাকার আমানত অথবা লিয়েন থাকার কথা বলা হয়েছে। এক জায়গায় বলা আছে, কৃষিপণ্য আমদানি ও বিপণনের জন্য এই অর্থ ব্যবহার হবে, কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি প্রতিবেদন অনুসারে বিভিন্ন ব্যাংকে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের এক্সপোজার মাত্র সাড়ে ৮ লাখ টাকা।

প্রকল্প ঋণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গ্রাহক একেবারে নতুন। ফলে সম্পূর্ণ নতুন একজন গ্রাহককে বাণিজ্যের জন্য এই পরিমাণ ঋণ দেয়া হলো। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের বড় ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা এবং অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কি না, তা যাচাই করা দরকার।

নাবিল ফিড মিলসের নামে নতুন করে ৭০০ কোটি টাকাসহ মোট ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা, কিন্তু নাবিল গ্রেইন ক্রপস কোনো গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্দেহ, এটিও গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। ফলে একক কোনো গ্রুপকে ঋণ দেয়া সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে, এটি তার লঙ্ঘন।

প্রসঙ্গত, নাবিল গ্রুপের ওয়েব সাইটে গ্রুপটির ১৭টি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- নাবিল নব ফুড, ফ্লাওয়ার মিল, ফিডমিল, অটোরাইস মিল, ডাল মিল, কনজুমার প্রোডাক্ট, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম এবং নাবিল ট্রান্সপোর্ট উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই ওয়েব সাইটে প্রোডাক্ট অপশনে মাত্র ৬টি পণ্যের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- চাল, আটা, ময়দা, সুজি, ডাল এবং পশুখাদ্য। কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. জাহান বক্স মন্ডল, পরিচালক ইসরাত জাহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম এবং উপ পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ।

আরও পড়ুন: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ৯ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ

ঢাকা/এসএ

শেয়ার করুন

x
English Version

জামানত ছাড়াই নাবিল গ্রুপে ৬৫০০ কোটি টাকার ঋণ!

আপডেট: ১২:১৩:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: বেসরকারি তিন ব্যাংক পর্যাপ্ত নথিপত্র ও জামানত ছাড়াই প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ‘নাবিল গ্রুপ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। যার মধ্যে শুধু ইসলামী ব্যাংকই ঋণ দিয়েছে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা। এ টাকা আইন লঙ্ঘন করে দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এছাড়াও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ২০০ কোটি এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। যা আইন লঙ্ঘন করে দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২১ মার্চ ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা নাবিল ফিড মিলস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয়। ব্যাংকটির গুলশান শাখায় নাবিল গ্রেইন ক্রপসের নামে অনুমোদন দেয়া হয় ৯৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ব্যাংকটি দিচ্ছে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা।

গত ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৪৬তম বোর্ড সভায় নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়।

গত ৩০ মে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ড সভায় গুলশান শাখা থেকে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়।

আইন বলছে, কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ কোনো কোম্পানি বা গ্রুপকে দিতে পারবে না। এই ঋণ ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড উভয় মিলেই। এ ক্ষেত্রে ফান্ডেড বা সরাসরি ঋণ হবে ১৫ শতাংশ, যা বড় ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আগে সুদসহ ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ শতাংশ।

নন-ফান্ডেড ঋণে রপ্তানি খাতের ক্ষেত্রে ১০০ টাকার ঋণকে ৫০ টাকা এবং বিদ্যুৎ খাতের ক্ষেত্রে ১০০ টাকার ঋণকে ২৫ টাকা হিসেবে গণনা করতে হবে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এমন নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

এমতাবস্থায় দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ আইন লঙ্ঘন করেছে। কেননা ব্যাংকটি গত জুন শেষে মোট মূলধনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ হিসেবে ব্যাংকটি একটি গ্রুপকে সর্বোচ্চ দিতে পারবে ২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কিন্তু তারা দিচ্ছে এর চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি।

একই অবস্থা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের। যথাক্রমে ব্যাংক দুইটির মূলধন ছিল তিন হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ও তিন হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংক দু্ইটি নাবিল গ্রুপকে সর্বোচ্চ ঋণ দিতে পারতো  ৯৩০ কোটি ও ৮১৪ কোটি টাকা। কিন্তু দুইটি ব্যাংকই বেশি দিয়েছে ২৭০ কোটি ও ২৯৬ কোটি টাকা টাকা।

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অফ অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ। স্পষ্টতই অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে কিছু বলা হচ্ছে না। তবে নাবিল গ্রুপ দাবি করেছে, তারা নিয়ম মেনেই ঋণ পেয়েছে। নতুন একটি প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হলেও পর্যাপ্ত নথি নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ ঋণেই কোনো ধরনের জামানত রাখা হয়নি। এই ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার হবে তাও পরিষ্কার নয়। এ ছাড়া নতুন একটি গ্রুপকে এত টাকা ঋণ দেয়া হলেও তার পর্যাপ্ত নথি সংরক্ষণ করা হয়নি।

গ্রুপের একটি কোম্পানিকে ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট অনুসারে, এর আগে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ওই কোম্পানির ঋণ রয়েছে মাত্র সাড়ে ৮ লাখ টাকা। ফলে এই পরিমাণ অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে কি না, তাও যাচাই করা হয়নি।

এই ঋণ ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ কি না, সেই সন্দেহ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। বিশেষ নিরীক্ষার সুপারিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, এত বড় অঙ্কের ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেয়া হয়নি। তিন মাসে এলসি কমিশন মাত্র দশমিক ১৫ শতাংশ। গ্যারান্টির ক্ষেত্রে নাবিল ফার্মের করপোরেট গ্যারান্টি গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ড মিটিংয়ে ঋণ অনুমোদন দেয়া হলেও ৪৮২ এবং ৪৮৩তম বোর্ড সভায় শর্ত শিথিল করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গ্যারান্টির ক্ষেত্রে সব পরিচালক এবং তাদের স্বামী/স্ত্রীর গ্যারান্টি ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে শর্ত শিথিল করে শুধু পরিচালকদের গ্যারান্টি রাখা হয়।

আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বলা হয়, নিজ নামে অথবা রেফারেন্সে অন্যদের নামে প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি এবং পরবর্তী সময়ে আমানত ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে, কিন্তু পরে তা শিথিল করে বলা হয়, পর্যাপ্ত আমানত রাখতে হবে। এই পর্যাপ্তের কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, একটি নতুন ঋণের ক্ষেত্রে কোন বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা হলো তা জানা জরুরি। এ ছাড়া গ্রাহক বেনামে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান কি না, সেটিও যাচাই করতে হবে। কোন বিবেচনায় নতুন একজন গ্রাহককে তিন ব্যাংক এত বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তা যাচাই করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে ফোর্সড (বাধ্যতামূলক) ঋণ আদায় অগ্রগতি অবহিত করা, কোন বিবেচনায় এই ঋণ দেয়া হলো, তার ব্যাখ্যা এবং বিস্তারিত কাগজপত্র জমা দেয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলশান শাখার নতুন গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রপসের অনুকূলে ৯৫০ কোটি টাকা নন ফান্ডেড ঋণ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে এই ঋণে ২৩০ কোটি টাকা জামানত হওয়ার কথা। ঋণের শর্তে ১১০ কোটি টাকার আমানত অথবা লিয়েন থাকার কথা বলা হয়েছে। এক জায়গায় বলা আছে, কৃষিপণ্য আমদানি ও বিপণনের জন্য এই অর্থ ব্যবহার হবে, কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি প্রতিবেদন অনুসারে বিভিন্ন ব্যাংকে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের এক্সপোজার মাত্র সাড়ে ৮ লাখ টাকা।

প্রকল্প ঋণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গ্রাহক একেবারে নতুন। ফলে সম্পূর্ণ নতুন একজন গ্রাহককে বাণিজ্যের জন্য এই পরিমাণ ঋণ দেয়া হলো। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের বড় ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা এবং অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কি না, তা যাচাই করা দরকার।

নাবিল ফিড মিলসের নামে নতুন করে ৭০০ কোটি টাকাসহ মোট ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা, কিন্তু নাবিল গ্রেইন ক্রপস কোনো গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্দেহ, এটিও গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। ফলে একক কোনো গ্রুপকে ঋণ দেয়া সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে, এটি তার লঙ্ঘন।

প্রসঙ্গত, নাবিল গ্রুপের ওয়েব সাইটে গ্রুপটির ১৭টি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- নাবিল নব ফুড, ফ্লাওয়ার মিল, ফিডমিল, অটোরাইস মিল, ডাল মিল, কনজুমার প্রোডাক্ট, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম এবং নাবিল ট্রান্সপোর্ট উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই ওয়েব সাইটে প্রোডাক্ট অপশনে মাত্র ৬টি পণ্যের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- চাল, আটা, ময়দা, সুজি, ডাল এবং পশুখাদ্য। কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. জাহান বক্স মন্ডল, পরিচালক ইসরাত জাহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম এবং উপ পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ।

আরও পড়ুন: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ৯ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ

ঢাকা/এসএ