১১:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

বিনিয়োগকারীদের গলার কাঁটা মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:৩৯:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মার্চ ২০২১
  • / ৪৯১৫ বার দেখা হয়েছে

সারা বিশ্বেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে মিউচুয়াল ফান্ড। বিশেষ করে পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন পরিস্থিতি অনুধাবন করার মতো সম্যক জ্ঞান না থাকা বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র এ ফান্ড। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিনিয়োগকারীদের কাছে মিউচুয়াল ফান্ড বেশ জনপ্রিয়। অথচ বৈশ্বিক এমন পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশের মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে। সংবাদ সূত্রঃ বনিকবার্তা 

মিউচুয়াল ফান্ড চালুর পর চার দশক পেরিয়ে গেলেও দেশে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি এ খাত। বিশেষ করে অধিকাংশ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড অভিহিত মূল্যের নিচে লেনদেন হওয়ার কারণে এ খাতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দিন দিন কমছে। পুঁজির চেয়ে ফান্ডের মূল্য কম হওয়ার কারণে তাদের অনেকেই রয়েছেন সিদ্ধান্তহীনতায়। এতে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।

দেশের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সম্পদ ব্যবস্থাপকদের হাতে ব্যবস্থাপনায় থাকা সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ৬ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকার সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড। এরপর এল আর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের কাছে রয়েছে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকার সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ৬৩৬ কোটি, এইমস বাংলাদেশ ৪৩৫ কোটি, ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ২৮৮ কোটি, স্ট্র্যাটেজিক ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড ২৫৪ কোটি, ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ২০৯ কোটি, সিএপিএম ১৩১ কোটি ও এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্সের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ৭৩ কোটি টাকার সম্পদ।

সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রেস ১০টি মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে। এছাড়া এল আর গ্লোবাল ছয়টি; আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নয়টি; স্ট্র্যাটেজিক ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড তিনটি; এইমস বাংলাদেশ, ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ও ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট দুটি করে এবং এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্সের দায়িত্বে রয়েছে একটি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ ৩৭টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে বর্তমানে ৩৫টি ফান্ডই ডিসকাউন্টে লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ ফান্ডগুলোর বর্তমান বাজারদর সেগুলোর নিট সম্পদমূল্যের (এনএভি) চেয়ে কম। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফান্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিসকাউন্টে লেনদেন হচ্ছে বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় থাকা ৫ ফান্ডের। এর মধ্যে ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড ৫৬ শতাংশ, পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৫৬ শতাংশ, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ, ইবিএল এনআরবি মিউচুয়াল ফান্ড ৫৩ দশমিক ১ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ ডিসকাউন্টে পুঁজিবাজারে লেনদেন হচ্ছে।

বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত পুঁজি একত্র করে মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে থাকে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলো। ফান্ডের অর্থ পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজার দুই ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা ২০০১-এর বিধান অনুসারে, এক্ষেত্রে ফান্ডের মোট অর্থের ৬০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে, যার অর্ধেক অর্থ আবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে হবে। মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর পোর্টফোলিওতে থাকা অন্তর্নিহিত সম্পদের ওপর ফান্ডগুলো থেকে বিনিয়োগকারীদের রিটার্নের পরিমাণ নির্ভর করে। এক্ষেত্রে পোর্টফোলিওতে থাকা সম্পদের মান ভালো হলে সেখান থেকে ভালো রিটার্ন আসে এবং সেই ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকে। এতে লভ্যাংশের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করে মূলধনি মুনাফাও অর্জন করতে পারেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সম্পদের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন সময় অতালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তেও এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ ও নিয়মবহির্ভূত বিনিয়োগের বিষয়টি ধরা পড়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপকদের এ ধরনের প্রবণতার কারণে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে কাঙ্ক্ষিত হারে রিটার্ন পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এতে এ খাতের প্রতি অনেক বিনিয়োগকারীই বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন।

এদিকে এসব ফান্ডের মেয়াদ পূর্বনির্ধারিত হওয়ার কারণে নির্ধারিত সময় শেষে এনএভির ভিত্তিতে বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার আশায় ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে বছর দুয়েক আগে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ আরো ১০ বছর বাড়ানোর ফলে বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেছে। মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট দর এনএভির সমান কিংবা তার বেশি না হলে এ মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের কাছে লোকসান ছাড়া ফান্ডের বিনিয়োগ তুলে আনার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া মেয়াদি ফান্ডের অধিকাংশই ডিসকাউন্টে লেনদেন হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা বর্তমান বাজারমূল্যে ইউনিট বিক্রি করতে চাইলে লোকসান গুনতে হবে তাদের। আর লাভে বিক্রি করতে হলে ফান্ডগুলোর বাজারদর কবে এনএভিকে ছাড়িয়ে যাবে, সে অপেক্ষায় থাকতে হবে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো পরিচালনা করার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপকরা সেই দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না। সম্পদ ব্যবস্থাপকের দক্ষতার সঙ্গে ফান্ড ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণেই সেখান থেকে বিনিয়োগকারীরা কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে সম্পদ ব্যবস্থাপকদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ফি নির্ধারণ করা, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির রেটিং করাসহ তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম ২০০০ সালে মিউচুয়াল ফান্ড আনে এইমস বাংলাদেশ। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াওয়ার সাঈদ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপকরা দক্ষতা ও সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ফান্ডের পারফরম্যান্সে এর প্রতিফলন হতো ও বিনিয়োগকারীরা ভালো রিটার্ন পেতেন। এজন্য সম্পদ ব্যবস্থাপকদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ফি নির্ধারণ করার বিষয়টি চালু করা প্রয়োজন। অন্যান্য দেশে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর রেটিং রয়েছে, যা আমাদের দেশেও চালু করা যেতে পারে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ট্রাস্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট যেসব আইন রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিকভাবে মিউচুয়াল ফান্ডের উন্নয়নে খাতসংশ্লিষ্ট সবারই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

বিশ্ব বিনিয়োগকারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের মিউচুয়াল ফান্ডের কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর সংস্কার দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তার মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক একটি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগ করেছে।

দেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সালমান এফ রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের নিয়মকানুনগুলোর সংস্কার দরকার, যা করবে বিএসইসি। সংস্কারের মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে আবারো শক্তিশালী করা হবে। এ বিষয়ে কমিশন কাজ করছে।

পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি গত এক দশকে অনেক ধরনের আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার করেছে। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ড খাতটির প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নজর সেভাবে ছিল না বলে অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের। এতে সম্পদ ব্যবস্থাপকরাও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে গত বছরের মে মাসে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন দায়িত্বে আসার পর পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ধরনের কার্যকর উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ডের অবস্থার পরিবর্তনের বিষয়টিও কমিশনের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। এরই মধ্যে আমরা সম্পদ ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিগত সময়ে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত রিটার্ন না দিতে পারার কারণ হিসেবে আমাদের জানিয়েছে যে পুঁজিবাজার পরিস্থিতির কারণে এ সময়ে তাদের সম্পদ কমে গেছে। তবে গত কয়েক বছরে তারা সেটি অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। চলতি হিসাব বছরেই তারা বিনিয়োগকারীদের ভালো রিটার্ন দিতে পারবে বলে আমাদের জানিয়েছে।

বিনিয়োগকারীরা রিটার্ন না পাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা যাতে বঞ্চিত না হয় সেটি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা মিউচুয়াল ফান্ডের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। এখানে নিত্যনতুন আরো অনেক নতুন পণ্য চালু করা হবে। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে দেশের মিউচুয়াল ফান্ডে গতি ফিরে আসবে।

ভারতের মিউচুয়াল ফান্ড খাত বেশ বৈচিত্র্যময়। সেখানে বড়, মাঝারি, মিশ্র ও স্বল্প মূলধনি কোম্পানি শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত ফান্ড ছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে এক্সিস ব্লুচিপ ফান্ড ডিরেক্ট প্ল্যান মিউচুয়াল ফান্ডে ২৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, কোটাক ইকুইটি অপরচুনিটিস ফান্ড ডিরেক্ট প্ল্যান ২২ দশমিক ৪৩, আইআইএফএল ফোকাসড ইকুইটি ফান্ড ৩৪ দশমিক ৩২ শতাংশ, এক্সিস মিডক্যাপ ফান্ড ২৩ দশমিক ৪১ এবং এক্সিস স্মল ক্যাপ ফান্ডে ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ রিটার্ন এসেছে। দেশটিতে বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য পেনশনভিত্তিক মিউচুয়াল ফান্ডও রয়েছে, যেগুলোতে বিনিয়োগের বিপরীতে এক বছরে সর্বনিম্ন ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত রিটার্ন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারেও শীর্ষস্থানীয় মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের পারফরম্যান্স ঈর্ষণীয়। সেখানকার তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্ল্যাকরক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ট্রাস্ট ফান্ডটি গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩১১ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছে, যা সে সময়কার এসঅ্যান্ডপি ও নাসডাক সূচকের রিটার্নের চেয়েও বেশি।

দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ও মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডস (এএএমসিএমএফ)। বর্তমানে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাসান ইমাম। দেশের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড খাতের সার্বিক পারফরম্যান্সের বিষয়ে তার বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

অবশ্য গত বছরের অক্টোবরে বিশ্ব বিনিয়োগকারী দিবস উপলক্ষে এএএমসিএমএফ আয়োজিত এক সেমিনারে মিউচুয়াল ফান্ডের কম লভ্যাংশের কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন পুঁজিবাজারের মন্দাবস্থাকে দায়ী করেছেন তিনি। তার মতে, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা মিউচুয়াল ফান্ডের পারফরম্যান্স বিচারের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি দরকেই বিবেচনা করে থাকেন, যেখানে এনএভিই মূল মানদণ্ড হওয়া উচিত। তাছাড়া কিছু মানুষ মনে করেন যে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ফান্ডের অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে, তাই এখানে কিছুটা হলেও ঝুঁকি রয়েছে।

দেশের মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশার বিষয়টি উঠে এসেছে গবেষণায়ও। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) চারজন শিক্ষক গত বছর ‘ডু মিউচুয়াল ফান্ডস ইন বাংলাদেশ মিটস ইনভেস্টরস এক্সপেক্টেশনস’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনোভাব জানতে গবেষকরা তাদের বেশকিছু প্রশ্নে করেছেন। এতে অংশ নেয়া অধিকাংশ বিনিয়োগকারী মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে নগদ লভ্যাংশকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিপরীতে ৫২ শতাংশ বিনিয়োগকারী পুনর্বিনিয়োগ বা রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিটের (আরআইইউ) প্রতি অসন্তুষ্টি জানিয়েছেন। মিউচুয়াল ফান্ডের পারফরম্যান্স ও মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়েও বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া ৪০ শতাংশ বিনিয়োগকারী মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরআইইউকে বাধা হিসেবে দেখছেন। ৬৪ শতাংশ বিনিয়োগকারী মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপকদের সক্ষমতা নিয়ে আস্থাহীনতার কথা জানিয়েছেন।

মিউচুয়াল ফান্ডের আরআইইউ নিয়ে বরাবরই নাখোশ ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে পুঁজিবাজারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে মেয়াদি ও বে-মেয়াদি দুই ধরনের ফান্ডের ক্ষেত্রেই আরআইইউ পদ্ধতি বাতিল করে কেবল নগদ লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ রেখে আদেশ জারি করে খায়রুল কমিশন। আর এ সিদ্ধান্তের পর গত বছর অনেক মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডই বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি। অবশ্য এক্ষেত্রে গত বছরের পুঁজিবাজার মন্দারও কিছুটা প্রভাব ছিল।

ট্যাগঃ

শেয়ার করুন

x
English Version

বিনিয়োগকারীদের গলার কাঁটা মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড

আপডেট: ১১:৩৯:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মার্চ ২০২১

সারা বিশ্বেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে মিউচুয়াল ফান্ড। বিশেষ করে পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন পরিস্থিতি অনুধাবন করার মতো সম্যক জ্ঞান না থাকা বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র এ ফান্ড। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিনিয়োগকারীদের কাছে মিউচুয়াল ফান্ড বেশ জনপ্রিয়। অথচ বৈশ্বিক এমন পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশের মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে। সংবাদ সূত্রঃ বনিকবার্তা 

মিউচুয়াল ফান্ড চালুর পর চার দশক পেরিয়ে গেলেও দেশে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি এ খাত। বিশেষ করে অধিকাংশ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড অভিহিত মূল্যের নিচে লেনদেন হওয়ার কারণে এ খাতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দিন দিন কমছে। পুঁজির চেয়ে ফান্ডের মূল্য কম হওয়ার কারণে তাদের অনেকেই রয়েছেন সিদ্ধান্তহীনতায়। এতে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।

দেশের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সম্পদ ব্যবস্থাপকদের হাতে ব্যবস্থাপনায় থাকা সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ৬ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকার সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড। এরপর এল আর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের কাছে রয়েছে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকার সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ৬৩৬ কোটি, এইমস বাংলাদেশ ৪৩৫ কোটি, ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ২৮৮ কোটি, স্ট্র্যাটেজিক ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড ২৫৪ কোটি, ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ২০৯ কোটি, সিএপিএম ১৩১ কোটি ও এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্সের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ৭৩ কোটি টাকার সম্পদ।

সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রেস ১০টি মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে। এছাড়া এল আর গ্লোবাল ছয়টি; আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নয়টি; স্ট্র্যাটেজিক ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড তিনটি; এইমস বাংলাদেশ, ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ও ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট দুটি করে এবং এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্সের দায়িত্বে রয়েছে একটি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ ৩৭টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে বর্তমানে ৩৫টি ফান্ডই ডিসকাউন্টে লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ ফান্ডগুলোর বর্তমান বাজারদর সেগুলোর নিট সম্পদমূল্যের (এনএভি) চেয়ে কম। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফান্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিসকাউন্টে লেনদেন হচ্ছে বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় থাকা ৫ ফান্ডের। এর মধ্যে ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড ৫৬ শতাংশ, পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৫৬ শতাংশ, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ, ইবিএল এনআরবি মিউচুয়াল ফান্ড ৫৩ দশমিক ১ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ ডিসকাউন্টে পুঁজিবাজারে লেনদেন হচ্ছে।

বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত পুঁজি একত্র করে মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে থাকে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলো। ফান্ডের অর্থ পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজার দুই ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা ২০০১-এর বিধান অনুসারে, এক্ষেত্রে ফান্ডের মোট অর্থের ৬০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে, যার অর্ধেক অর্থ আবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে হবে। মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর পোর্টফোলিওতে থাকা অন্তর্নিহিত সম্পদের ওপর ফান্ডগুলো থেকে বিনিয়োগকারীদের রিটার্নের পরিমাণ নির্ভর করে। এক্ষেত্রে পোর্টফোলিওতে থাকা সম্পদের মান ভালো হলে সেখান থেকে ভালো রিটার্ন আসে এবং সেই ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকে। এতে লভ্যাংশের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করে মূলধনি মুনাফাও অর্জন করতে পারেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সম্পদের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন সময় অতালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তেও এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ ও নিয়মবহির্ভূত বিনিয়োগের বিষয়টি ধরা পড়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপকদের এ ধরনের প্রবণতার কারণে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে কাঙ্ক্ষিত হারে রিটার্ন পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এতে এ খাতের প্রতি অনেক বিনিয়োগকারীই বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন।

এদিকে এসব ফান্ডের মেয়াদ পূর্বনির্ধারিত হওয়ার কারণে নির্ধারিত সময় শেষে এনএভির ভিত্তিতে বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার আশায় ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে বছর দুয়েক আগে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ আরো ১০ বছর বাড়ানোর ফলে বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেছে। মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট দর এনএভির সমান কিংবা তার বেশি না হলে এ মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের কাছে লোকসান ছাড়া ফান্ডের বিনিয়োগ তুলে আনার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া মেয়াদি ফান্ডের অধিকাংশই ডিসকাউন্টে লেনদেন হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা বর্তমান বাজারমূল্যে ইউনিট বিক্রি করতে চাইলে লোকসান গুনতে হবে তাদের। আর লাভে বিক্রি করতে হলে ফান্ডগুলোর বাজারদর কবে এনএভিকে ছাড়িয়ে যাবে, সে অপেক্ষায় থাকতে হবে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো পরিচালনা করার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপকরা সেই দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না। সম্পদ ব্যবস্থাপকের দক্ষতার সঙ্গে ফান্ড ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণেই সেখান থেকে বিনিয়োগকারীরা কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে সম্পদ ব্যবস্থাপকদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ফি নির্ধারণ করা, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির রেটিং করাসহ তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম ২০০০ সালে মিউচুয়াল ফান্ড আনে এইমস বাংলাদেশ। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াওয়ার সাঈদ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপকরা দক্ষতা ও সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ফান্ডের পারফরম্যান্সে এর প্রতিফলন হতো ও বিনিয়োগকারীরা ভালো রিটার্ন পেতেন। এজন্য সম্পদ ব্যবস্থাপকদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ফি নির্ধারণ করার বিষয়টি চালু করা প্রয়োজন। অন্যান্য দেশে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলোর রেটিং রয়েছে, যা আমাদের দেশেও চালু করা যেতে পারে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ট্রাস্টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট যেসব আইন রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিকভাবে মিউচুয়াল ফান্ডের উন্নয়নে খাতসংশ্লিষ্ট সবারই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

বিশ্ব বিনিয়োগকারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের মিউচুয়াল ফান্ডের কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর সংস্কার দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তার মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক একটি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগ করেছে।

দেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সালমান এফ রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের নিয়মকানুনগুলোর সংস্কার দরকার, যা করবে বিএসইসি। সংস্কারের মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে আবারো শক্তিশালী করা হবে। এ বিষয়ে কমিশন কাজ করছে।

পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি গত এক দশকে অনেক ধরনের আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার করেছে। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ড খাতটির প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নজর সেভাবে ছিল না বলে অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের। এতে সম্পদ ব্যবস্থাপকরাও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে গত বছরের মে মাসে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন দায়িত্বে আসার পর পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ধরনের কার্যকর উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ডের অবস্থার পরিবর্তনের বিষয়টিও কমিশনের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। এরই মধ্যে আমরা সম্পদ ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিগত সময়ে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত রিটার্ন না দিতে পারার কারণ হিসেবে আমাদের জানিয়েছে যে পুঁজিবাজার পরিস্থিতির কারণে এ সময়ে তাদের সম্পদ কমে গেছে। তবে গত কয়েক বছরে তারা সেটি অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। চলতি হিসাব বছরেই তারা বিনিয়োগকারীদের ভালো রিটার্ন দিতে পারবে বলে আমাদের জানিয়েছে।

বিনিয়োগকারীরা রিটার্ন না পাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা যাতে বঞ্চিত না হয় সেটি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা মিউচুয়াল ফান্ডের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। এখানে নিত্যনতুন আরো অনেক নতুন পণ্য চালু করা হবে। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে দেশের মিউচুয়াল ফান্ডে গতি ফিরে আসবে।

ভারতের মিউচুয়াল ফান্ড খাত বেশ বৈচিত্র্যময়। সেখানে বড়, মাঝারি, মিশ্র ও স্বল্প মূলধনি কোম্পানি শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত ফান্ড ছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে এক্সিস ব্লুচিপ ফান্ড ডিরেক্ট প্ল্যান মিউচুয়াল ফান্ডে ২৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, কোটাক ইকুইটি অপরচুনিটিস ফান্ড ডিরেক্ট প্ল্যান ২২ দশমিক ৪৩, আইআইএফএল ফোকাসড ইকুইটি ফান্ড ৩৪ দশমিক ৩২ শতাংশ, এক্সিস মিডক্যাপ ফান্ড ২৩ দশমিক ৪১ এবং এক্সিস স্মল ক্যাপ ফান্ডে ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ রিটার্ন এসেছে। দেশটিতে বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য পেনশনভিত্তিক মিউচুয়াল ফান্ডও রয়েছে, যেগুলোতে বিনিয়োগের বিপরীতে এক বছরে সর্বনিম্ন ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত রিটার্ন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারেও শীর্ষস্থানীয় মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের পারফরম্যান্স ঈর্ষণীয়। সেখানকার তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্ল্যাকরক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ট্রাস্ট ফান্ডটি গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩১১ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছে, যা সে সময়কার এসঅ্যান্ডপি ও নাসডাক সূচকের রিটার্নের চেয়েও বেশি।

দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ও মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডস (এএএমসিএমএফ)। বর্তমানে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাসান ইমাম। দেশের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড খাতের সার্বিক পারফরম্যান্সের বিষয়ে তার বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

অবশ্য গত বছরের অক্টোবরে বিশ্ব বিনিয়োগকারী দিবস উপলক্ষে এএএমসিএমএফ আয়োজিত এক সেমিনারে মিউচুয়াল ফান্ডের কম লভ্যাংশের কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন পুঁজিবাজারের মন্দাবস্থাকে দায়ী করেছেন তিনি। তার মতে, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা মিউচুয়াল ফান্ডের পারফরম্যান্স বিচারের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি দরকেই বিবেচনা করে থাকেন, যেখানে এনএভিই মূল মানদণ্ড হওয়া উচিত। তাছাড়া কিছু মানুষ মনে করেন যে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ফান্ডের অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে, তাই এখানে কিছুটা হলেও ঝুঁকি রয়েছে।

দেশের মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশার বিষয়টি উঠে এসেছে গবেষণায়ও। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) চারজন শিক্ষক গত বছর ‘ডু মিউচুয়াল ফান্ডস ইন বাংলাদেশ মিটস ইনভেস্টরস এক্সপেক্টেশনস’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনোভাব জানতে গবেষকরা তাদের বেশকিছু প্রশ্নে করেছেন। এতে অংশ নেয়া অধিকাংশ বিনিয়োগকারী মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে নগদ লভ্যাংশকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিপরীতে ৫২ শতাংশ বিনিয়োগকারী পুনর্বিনিয়োগ বা রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিটের (আরআইইউ) প্রতি অসন্তুষ্টি জানিয়েছেন। মিউচুয়াল ফান্ডের পারফরম্যান্স ও মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়েও বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া ৪০ শতাংশ বিনিয়োগকারী মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরআইইউকে বাধা হিসেবে দেখছেন। ৬৪ শতাংশ বিনিয়োগকারী মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপকদের সক্ষমতা নিয়ে আস্থাহীনতার কথা জানিয়েছেন।

মিউচুয়াল ফান্ডের আরআইইউ নিয়ে বরাবরই নাখোশ ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে পুঁজিবাজারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে মেয়াদি ও বে-মেয়াদি দুই ধরনের ফান্ডের ক্ষেত্রেই আরআইইউ পদ্ধতি বাতিল করে কেবল নগদ লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ রেখে আদেশ জারি করে খায়রুল কমিশন। আর এ সিদ্ধান্তের পর গত বছর অনেক মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডই বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি। অবশ্য এক্ষেত্রে গত বছরের পুঁজিবাজার মন্দারও কিছুটা প্রভাব ছিল।