০৭:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

বীমা খাতের দর বৃদ্ধি: স্বাভাবিক নাকি কারসাজি?

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:৩৮:১৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২১
  • / ৪৪২৯ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদকঃ দ্বিতীয় ধাপে করোনার তান্ডব, লকডাউন এবং ফ্লোর প্রাইস সংক্রান্ত বিএসইসির নির্দেশনার প্রভাবে চলতি মাসের শুরু থেকেই পুজিবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আলোচ্য সময়ে তালিকাভুক্ত সব খাতের শেয়ার দর কমলেও শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বীমা খাত। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আবারো দুর্বল কোম্পানিগুলো ঘিরে কারসাজি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যেখানে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিগুলোর শেয়ার তলানিতে পড়ে রয়েছে সেখানে বীমা খাতের দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে কারসাজি চক্র মেতে উঠছে। দুর্বল বীমা খাতের শেয়ার নিয়ে মেতে উঠেছে এক শ্রেণীর অতি মুনাফালোভী বিনিয়োগকারীরা। এসব কারসাজি চক্র থেকে দূরে থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে সচেতন হওয়া জরুরি বলে তারা মনে করছেন।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার কারণে গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমেছে। বছর শেষে এসব কোম্পানির মুনাফাও আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এ বছরও করোনা চলছে, ফলে কোম্পানির মুনাফা হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে কারসাজি চক্রের দখলে রয়েছে বিমা কোম্পানির শেয়ার। ফলে এসব শেয়ারে মুনাফা হবেই বলে ধরে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ মুহূর্তে বিমায় বিনিয়োগের আগে দেখতে হবে কারসাজি চক্রের বিনিয়োগ রয়েছে কি না। নতুন করে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) তথ্য অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৮দিন লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে চারদিন উত্থান আর ৪ দিন পতন হয়েছে। এই ৮ দিনের ৬ দিনই বিমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়েছে। এসময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৫০টি বিমা কোম্পানির শেয়ারের অধিকাংশেরই দাম বাড়ে। দাম বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার। গত ৪ এপ্রিল কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ৯৫ টাকা। সেখান থেকে ২৯ টাকা ৮০ পয়সা বেড়ে ১৩ এপ্রিল শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১২৪ টাকা ৮০ পয়সায়। তাতে এ কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের মোট মুনাফা হয়েছে ৮৮ কোটি ৫১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৯ টাকা।

একইভাবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৭৪ টাকা থেকে ২২ টাকা ৬০ পয়সা বেড়ে ৯৬ টাকা ৬০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। তাতে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৯৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

শেয়ারপ্রতি ২১ টাকা করে দাম বাড়ায় সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা হয়েছে ৮৪ কোটি ৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৪৫ টাকা। ১৫ টাকা দাম বাড়ায় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের ৬০ কোটি ৭৬ হাজার ৬২০ টাকা মুনাফা হয়েছে। ১৪ টাকা দাম বাড়ায় ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশের মুনাফা হয়েছে ৫২ কোটি ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৯২২ টাকা।

১২ টাকা দাম বাড়ায় পাইওনিয়র ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৮৩ কোটি ৯৭ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে ১২ টাকা বাড়ায় ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের মুনাফা হয়েছে ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ১১ টাকা বেড়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৪৬ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার ৭২১ টাকা।

এছাড়াও ১০ টাকা করে শেয়ারের দাম বাড়ায় ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুনাফা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্সের ৪০ কোটি ৫৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৩০ টাকা এবং রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ৭৬ কোটি ৬৬ লাখ ৫৪ হাজার ১২০ টাকার।

ডিএসইর তথ্যমতে, গত ৪ এপ্রিল কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম ছিল ৩৩ টাকা। সেখান থেকে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা বেড়ে শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সায়। ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৩৪ টাকা ৮ পয়সা থেকে ১৪ টাকা ৮২ পয়সা বেড়ে ৪৮ টাকা ৯০ পয়সায় কেনা-বেচা হয়েছে। একইভাবে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৫৬ টাকা ৩ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৫৭ পয়সা বেড়ে ৬৮ টাকা ৬০ পয়সা দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৩৮ টাকা ৯ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৬১ পয়সা বেড়ে ৫০ টাকা ৭০ পয়সায়, ২৯ টাকা থেকে ১১ টাকা ২০ পয়সা বেড়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৪০ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স শেয়ার ৩২ টাকা ৪ পয়সা থেকে বেড়ে ৪২ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এছাড়াও ২৮ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১০ টাকা বেড়ে গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ার ৩৮ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।

এদিকে দশ টাকার কমমূল্যের শেয়ারের দাম বেড়েছে কয়েকটি কোম্পানির। এগুলো হচ্ছে -অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, সেন্ট্রাল, সিটি জেনারেল, দেশ জেনারেল, ইস্টার্ন, ইস্টল্যান্ড, এক্সপ্রেস, ফেডারেল, গ্রিন ডেল্টা, ইসলামী কমার্শিয়াল, জনতা, কর্ণফুলী, মেঘনা, মার্কেন্টাইল, নিটল, প্যারামাউন্ট, পিপলস প্রগতি, প্রাইম, পূরবী জেনারেল, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স এবং রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এছাড়াও রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, তাকাফুল ইসলামি ইন্স্যুরেন্স এবং ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

আইডিআরএর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিদায়ী বছরের (৩১ ডিসেম্বর ২০২০) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত-অতালিকাভুক্ত সব বিমা কোম্পানির প্রিমিয়াম বাবদ আয় হয়েছে ১৩ হাজার ৮২১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে হয়েছিল ১৪ হাজার ৩১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। করোনার বছরের বিমা কোম্পানির প্রিমিয়াম বাবদ আয় কমেছে ৫০০ কোটি টাকা। তাতে আগের বছরের তুলনায় মুনাফাও কমেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানিগুলোর। তবে এসব কোম্পানির শেয়ারে দাম দফায় বাড়ছে। এই সময়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম বেড়েছে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, পুঁজিবাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর বাড়বে আবার কমবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন রকম কারণ ছাড়াই কোন কোম্পানির শেয়ার দর হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াটার মানে অন্য কিছু বুঝায়। নিশ্চয় এ কোম্পানিটিতে কারসাজি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে এখনি সাবধান থাকতে হবে। নয়তো নতুন করে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে শর্তে বলেন, বীমা খাতের কোম্পানিগুলো নিয়ে কারসাজি চলছে। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত বীমা খাতের এসব কোম্পানির বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিমা কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে। এ কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনে পুঁজিবাজার বন্ধ থাকার গুজব কিংবা সব কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে দরপতনের সময়ও বিমা কোম্পানির দাম বেড়েছে। হয়তো এ সময়ে কিছু বিনিয়োগকারী মুনাফা করেছে, তবে এসব শেয়ার বিনিয়োগে ঝুঁকির মাত্রাও বাড়ছে।
অবশ্য এর আগেও বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সামনে বিমা কোম্পানিগুলো ভালো করবে। কারণ সম্পদের তুলনায় অর্থনীতিতে বিমা খাতের অবদান কম। ফলে এখনো ভালো করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

বিমা খাতের শেয়ারের দামের আবার এ উত্থানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবারও আতঙ্ক ভর করেছে।
একাধিক বিনিয়োগকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এর আগেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে হুহু করে বিমা খাতের শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছিল। পরে তা কমে যায়। ওই সময় কারসাজিকারকদের কেউ কেউ হয়তো তাদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করতে পারেনি। তাই দ্বিতীয়বারের মতো দাম বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে হাতে থাকা বাকি শেয়ার বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এ ছাড়া বিমা কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

প্রসঙ্গত, বিমার শেয়ার নিয়ে এর আগে কারসাজি হয়েছিল গত বছরের আগস্ট-নভেম্বরে। তখন এ খাতের কোনো কোনো শেয়ারের দাম ৪-৫ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। পরে ওই দাম কমতে শুরু করে। তাতেই বেশি দামে শেয়ার কিনে সবচেয়ে বেশি লোকসানে পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। গত বছর একটি সংঘবদ্ধ চক্র কারসাজির মাধ্যমে বিমার শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটায়। নানা তদন্তে সেসব কারসাজি চক্রের নামও বেরিয়ে আসে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন এসে আবারও পুরোনো কারসাজি চক্র বিমা শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে মেতেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঢাকা/এইচজে

শেয়ার করুন

x
English Version

বীমা খাতের দর বৃদ্ধি: স্বাভাবিক নাকি কারসাজি?

আপডেট: ১১:৩৮:১৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২১

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদকঃ দ্বিতীয় ধাপে করোনার তান্ডব, লকডাউন এবং ফ্লোর প্রাইস সংক্রান্ত বিএসইসির নির্দেশনার প্রভাবে চলতি মাসের শুরু থেকেই পুজিবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আলোচ্য সময়ে তালিকাভুক্ত সব খাতের শেয়ার দর কমলেও শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বীমা খাত। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আবারো দুর্বল কোম্পানিগুলো ঘিরে কারসাজি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যেখানে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিগুলোর শেয়ার তলানিতে পড়ে রয়েছে সেখানে বীমা খাতের দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে কারসাজি চক্র মেতে উঠছে। দুর্বল বীমা খাতের শেয়ার নিয়ে মেতে উঠেছে এক শ্রেণীর অতি মুনাফালোভী বিনিয়োগকারীরা। এসব কারসাজি চক্র থেকে দূরে থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে সচেতন হওয়া জরুরি বলে তারা মনে করছেন।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার কারণে গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা কমেছে। বছর শেষে এসব কোম্পানির মুনাফাও আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এ বছরও করোনা চলছে, ফলে কোম্পানির মুনাফা হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে কারসাজি চক্রের দখলে রয়েছে বিমা কোম্পানির শেয়ার। ফলে এসব শেয়ারে মুনাফা হবেই বলে ধরে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ মুহূর্তে বিমায় বিনিয়োগের আগে দেখতে হবে কারসাজি চক্রের বিনিয়োগ রয়েছে কি না। নতুন করে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) তথ্য অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৮দিন লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে চারদিন উত্থান আর ৪ দিন পতন হয়েছে। এই ৮ দিনের ৬ দিনই বিমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়েছে। এসময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৫০টি বিমা কোম্পানির শেয়ারের অধিকাংশেরই দাম বাড়ে। দাম বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার। গত ৪ এপ্রিল কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ৯৫ টাকা। সেখান থেকে ২৯ টাকা ৮০ পয়সা বেড়ে ১৩ এপ্রিল শেয়ার বিক্রি হয়েছে ১২৪ টাকা ৮০ পয়সায়। তাতে এ কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের মোট মুনাফা হয়েছে ৮৮ কোটি ৫১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৯ টাকা।

একইভাবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৭৪ টাকা থেকে ২২ টাকা ৬০ পয়সা বেড়ে ৯৬ টাকা ৬০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। তাতে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৯৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

শেয়ারপ্রতি ২১ টাকা করে দাম বাড়ায় সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা হয়েছে ৮৪ কোটি ৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৪৫ টাকা। ১৫ টাকা দাম বাড়ায় কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের ৬০ কোটি ৭৬ হাজার ৬২০ টাকা মুনাফা হয়েছে। ১৪ টাকা দাম বাড়ায় ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশের মুনাফা হয়েছে ৫২ কোটি ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৯২২ টাকা।

১২ টাকা দাম বাড়ায় পাইওনিয়র ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৮৩ কোটি ৯৭ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে ১২ টাকা বাড়ায় ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের মুনাফা হয়েছে ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ১১ টাকা বেড়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ৪৬ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার ৭২১ টাকা।

এছাড়াও ১০ টাকা করে শেয়ারের দাম বাড়ায় ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের মুনাফা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্সের ৪০ কোটি ৫৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৩০ টাকা এবং রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ৭৬ কোটি ৬৬ লাখ ৫৪ হাজার ১২০ টাকার।

ডিএসইর তথ্যমতে, গত ৪ এপ্রিল কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম ছিল ৩৩ টাকা। সেখান থেকে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা বেড়ে শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সায়। ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৩৪ টাকা ৮ পয়সা থেকে ১৪ টাকা ৮২ পয়সা বেড়ে ৪৮ টাকা ৯০ পয়সায় কেনা-বেচা হয়েছে। একইভাবে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৫৬ টাকা ৩ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৫৭ পয়সা বেড়ে ৬৮ টাকা ৬০ পয়সা দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৩৮ টাকা ৯ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৬১ পয়সা বেড়ে ৫০ টাকা ৭০ পয়সায়, ২৯ টাকা থেকে ১১ টাকা ২০ পয়সা বেড়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৪০ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স শেয়ার ৩২ টাকা ৪ পয়সা থেকে বেড়ে ৪২ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এছাড়াও ২৮ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১০ টাকা বেড়ে গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের শেয়ার ৩৮ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।

এদিকে দশ টাকার কমমূল্যের শেয়ারের দাম বেড়েছে কয়েকটি কোম্পানির। এগুলো হচ্ছে -অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, সেন্ট্রাল, সিটি জেনারেল, দেশ জেনারেল, ইস্টার্ন, ইস্টল্যান্ড, এক্সপ্রেস, ফেডারেল, গ্রিন ডেল্টা, ইসলামী কমার্শিয়াল, জনতা, কর্ণফুলী, মেঘনা, মার্কেন্টাইল, নিটল, প্যারামাউন্ট, পিপলস প্রগতি, প্রাইম, পূরবী জেনারেল, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স এবং রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এছাড়াও রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, তাকাফুল ইসলামি ইন্স্যুরেন্স এবং ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

আইডিআরএর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিদায়ী বছরের (৩১ ডিসেম্বর ২০২০) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত-অতালিকাভুক্ত সব বিমা কোম্পানির প্রিমিয়াম বাবদ আয় হয়েছে ১৩ হাজার ৮২১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে হয়েছিল ১৪ হাজার ৩১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। করোনার বছরের বিমা কোম্পানির প্রিমিয়াম বাবদ আয় কমেছে ৫০০ কোটি টাকা। তাতে আগের বছরের তুলনায় মুনাফাও কমেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানিগুলোর। তবে এসব কোম্পানির শেয়ারে দাম দফায় বাড়ছে। এই সময়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম বেড়েছে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, পুঁজিবাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর বাড়বে আবার কমবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন রকম কারণ ছাড়াই কোন কোম্পানির শেয়ার দর হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াটার মানে অন্য কিছু বুঝায়। নিশ্চয় এ কোম্পানিটিতে কারসাজি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে এখনি সাবধান থাকতে হবে। নয়তো নতুন করে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে শর্তে বলেন, বীমা খাতের কোম্পানিগুলো নিয়ে কারসাজি চলছে। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত বীমা খাতের এসব কোম্পানির বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিমা কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে। এ কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনে পুঁজিবাজার বন্ধ থাকার গুজব কিংবা সব কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে দরপতনের সময়ও বিমা কোম্পানির দাম বেড়েছে। হয়তো এ সময়ে কিছু বিনিয়োগকারী মুনাফা করেছে, তবে এসব শেয়ার বিনিয়োগে ঝুঁকির মাত্রাও বাড়ছে।
অবশ্য এর আগেও বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সামনে বিমা কোম্পানিগুলো ভালো করবে। কারণ সম্পদের তুলনায় অর্থনীতিতে বিমা খাতের অবদান কম। ফলে এখনো ভালো করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

বিমা খাতের শেয়ারের দামের আবার এ উত্থানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবারও আতঙ্ক ভর করেছে।
একাধিক বিনিয়োগকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এর আগেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে হুহু করে বিমা খাতের শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছিল। পরে তা কমে যায়। ওই সময় কারসাজিকারকদের কেউ কেউ হয়তো তাদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করতে পারেনি। তাই দ্বিতীয়বারের মতো দাম বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে হাতে থাকা বাকি শেয়ার বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এ ছাড়া বিমা কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

প্রসঙ্গত, বিমার শেয়ার নিয়ে এর আগে কারসাজি হয়েছিল গত বছরের আগস্ট-নভেম্বরে। তখন এ খাতের কোনো কোনো শেয়ারের দাম ৪-৫ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। পরে ওই দাম কমতে শুরু করে। তাতেই বেশি দামে শেয়ার কিনে সবচেয়ে বেশি লোকসানে পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। গত বছর একটি সংঘবদ্ধ চক্র কারসাজির মাধ্যমে বিমার শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটায়। নানা তদন্তে সেসব কারসাজি চক্রের নামও বেরিয়ে আসে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন এসে আবারও পুরোনো কারসাজি চক্র বিমা শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে মেতেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঢাকা/এইচজে