০২:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
সাত মাসে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার

রেকর্ড পরিমানে বাড়ছে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি

বিশেষ প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১২:০১:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ ২০২৪
  • / ৪২৭৬ বার দেখা হয়েছে

দেশে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি আবারো বাড়তে শুরু করেছে। ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে এ ঘাটতি ২১১ কোটি বা ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। জানুয়ারি পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এ হিসাবে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে এ পরিমাণ ঘাটতি এর আগে কখনই দেখা যায়নি। মূলত কোনো দেশের বিদেশি লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) একটি প্রধান উপাদান আর্থিক হিসাব।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি ছিল মাত্র ৮১ কোটি ডলার। গত রোববার (১০ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস শেষে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশের বিওপির ঘাটতি আরো স্ফীত হয়েছে। ডিসেম্বর শেষে বিওপির ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু জানুয়ারি শেষে বিওপির ঘাটতি বেড়ে ৪ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আমদানি কমিয়ে আনা ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও সামগ্রিক ঘাটতি বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের উপাদান নিট ট্রেড ক্রেডিট প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিওপির ওপর। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নিট ট্রেড ক্রেডিট ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নিট ট্রেড ক্রেডিট প্রবাহ ঋণাত্মক ৯ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ট্রেড ক্রেডিটের অস্বাভাবিক এ নেতিবাচক ধারাই ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে রেকর্ড ঘাটতি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে বিওপির তথ্য প্রকাশ করা হয়। বিভাগটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশ থেকে রফতানি করা পণ্যের অর্থ যথাসময়ে প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না। অপ্রত্যাবাসিত এ অর্থের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। নিট ট্রেড ক্রেডিটের ঋণাত্মক ধারা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তবে ইউপাস এলসি, বিলম্বিত বা ডেফারড এলসি, বিদেশী বিনিয়োগ না আসা, দেশের বেসরকারি খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ চলে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: আমানত সংগ্রহে আগ্রাসী হয়ে উঠছে ব্যাংকিং খাত!

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশি ঋণ ছাড় কমে যাওয়া, সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়া এবং কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। আবার যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তা সময়মতো দেশে আসছে না। রপ্তানি আয় সময়মতো দেশে না আসাকেও আর্থিক হিসাবের ঘাটতির বড় একটি কারণ মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। প্রবাসী আয়ের অতিরিক্ত প্রণোদনা ও দামের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি তুলে নেওয়ার পর প্রবাসী আয় বেড়েছে। কিন্তু রপ্তানি আয়ে ডলারের আগের দাম অব্যাহত আছে। ভিন্নভাবে আসার কারণে ডলারের দাম ভিন্ন হবে, তা তো হতে পারে না। এ জন্য চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হলেও আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানির জন্য জাহাজে উঠছে, তার পুরো অর্থ দেশে আসছে না। যেটুকু প্রয়োজন, শুধু তা–ই আনছেন রপ্তানিকারকেরা।’

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে ডলারের এক দাম ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দাম বাজারভিত্তিক করে দিলে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দূর হবে। আজ বা কাল এদিকে যেতেই হবে। তাই আগেভাগে যাওয়াই ভালো।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনার কারণে দেশের চলতি হিসাব এখন উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরেছে। গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও বেশ ভালো। তবে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো সম্ভব হয়নি। এ ঘাটতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। আশা করছি, পরিস্থিতির দ্রুতই উন্নতি হবে।’

আরও পড়ুন: ১২ ব্যাংকের অবস্থা ‌খুবই খারাপ, ৯টিতে জ্বলছে লাল বাতি!

গত অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আমদানি ১৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। টানা দুই অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনার প্রভাবে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমে এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ সময়ে দেশের রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থবছরের সাত মাসে রেমিট্যান্সে ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমদানি কমিয়ে আনা এবং রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কারণে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। জানুয়ারি শেষে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে চলতি হিসাবে ৪ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হিসাব অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সার্বিক আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ কমে ৩০৫ কোটি ডলারে নেমেছে। একই সময়ে রপ্তানি শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে ২৫৯ কোটি ডলার হয়েছে। এতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে ৪৫৯ কোটি ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ২৩১ কোটি ডলার।

আর্থিক হিসাবের অন্যতম উপাদান হলো বিদেশি বিনিয়োগ। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ১৮২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৮ শতাংশ কম। এ সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ৯৫ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। ফলে গত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ৫৩৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা জুলাই-নভেম্বর সময়ে ছিল ৫৪৮ কোটি ডলার। এদিকে গত ডিসেম্বর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ৬৪৫ কোটি ডলার।

ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের রেকর্ড ঘাটতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে এর আগে গভর্নরসহ নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। ঘাটতি কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও জানানো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়েছিল, জাতীয় নির্বাচনের পর ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি কমে আসবে। কিন্তু জানুয়ারির পরিসংখ্যান বিপরীত তথ্যই দিচ্ছে।

ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতির অর্থ হলো দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। গুরুত্বপূর্ণ এ হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না। আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ অ্যাসেট বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সহায়তা, সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধ, বাণিজ্যিক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ট্রেড ক্রেডিট বা রফতানির বিপরীতে অপ্রত্যাবাসিত অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদ ও দায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত দেশে ডলারপ্রবাহের প্রায় সবক’টি খাতই সংকুচিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘দুর্বল ব্যাংকের তালিকা নিজস্ব রিসার্সের জন্য করা হয়েছে’

কোনো দেশে আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা বাড়া বা কমার বিষয়টি পরিমাপ করা হয় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। এ হিসাবে ঘাটতি তৈরি হলে দেশের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়ে। চলতি শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশের আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত ছিল। বিশেষ করে ২০১০ সাল-পরবর্তী এক যুগে কখনই ঘাটতি দেখা যায়নি। কিন্তু ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। গত অর্থবছর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১৪ কোটি ২০ লাখ ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরেও আর্থিক হিসাবে ১ হাজার ৪০৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে ৮৬৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫১৩ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯০১ কোটি ১০ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪২৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

বিজনেস জার্নাল/এসআর

শেয়ার করুন

x
English Version

সাত মাসে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার

রেকর্ড পরিমানে বাড়ছে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি

আপডেট: ১২:০১:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ ২০২৪

দেশে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি আবারো বাড়তে শুরু করেছে। ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে এ ঘাটতি ২১১ কোটি বা ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। জানুয়ারি পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এ হিসাবে ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে এ পরিমাণ ঘাটতি এর আগে কখনই দেখা যায়নি। মূলত কোনো দেশের বিদেশি লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) একটি প্রধান উপাদান আর্থিক হিসাব।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি ছিল মাত্র ৮১ কোটি ডলার। গত রোববার (১০ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস শেষে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশের বিওপির ঘাটতি আরো স্ফীত হয়েছে। ডিসেম্বর শেষে বিওপির ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু জানুয়ারি শেষে বিওপির ঘাটতি বেড়ে ৪ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আমদানি কমিয়ে আনা ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও সামগ্রিক ঘাটতি বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের উপাদান নিট ট্রেড ক্রেডিট প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিওপির ওপর। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নিট ট্রেড ক্রেডিট ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নিট ট্রেড ক্রেডিট প্রবাহ ঋণাত্মক ৯ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ট্রেড ক্রেডিটের অস্বাভাবিক এ নেতিবাচক ধারাই ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে রেকর্ড ঘাটতি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে বিওপির তথ্য প্রকাশ করা হয়। বিভাগটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশ থেকে রফতানি করা পণ্যের অর্থ যথাসময়ে প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না। অপ্রত্যাবাসিত এ অর্থের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। নিট ট্রেড ক্রেডিটের ঋণাত্মক ধারা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তবে ইউপাস এলসি, বিলম্বিত বা ডেফারড এলসি, বিদেশী বিনিয়োগ না আসা, দেশের বেসরকারি খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ চলে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: আমানত সংগ্রহে আগ্রাসী হয়ে উঠছে ব্যাংকিং খাত!

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশি ঋণ ছাড় কমে যাওয়া, সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়া এবং কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। আবার যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তা সময়মতো দেশে আসছে না। রপ্তানি আয় সময়মতো দেশে না আসাকেও আর্থিক হিসাবের ঘাটতির বড় একটি কারণ মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। প্রবাসী আয়ের অতিরিক্ত প্রণোদনা ও দামের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি তুলে নেওয়ার পর প্রবাসী আয় বেড়েছে। কিন্তু রপ্তানি আয়ে ডলারের আগের দাম অব্যাহত আছে। ভিন্নভাবে আসার কারণে ডলারের দাম ভিন্ন হবে, তা তো হতে পারে না। এ জন্য চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হলেও আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানির জন্য জাহাজে উঠছে, তার পুরো অর্থ দেশে আসছে না। যেটুকু প্রয়োজন, শুধু তা–ই আনছেন রপ্তানিকারকেরা।’

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে ডলারের এক দাম ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দাম বাজারভিত্তিক করে দিলে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দূর হবে। আজ বা কাল এদিকে যেতেই হবে। তাই আগেভাগে যাওয়াই ভালো।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনার কারণে দেশের চলতি হিসাব এখন উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরেছে। গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও বেশ ভালো। তবে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো সম্ভব হয়নি। এ ঘাটতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। আশা করছি, পরিস্থিতির দ্রুতই উন্নতি হবে।’

আরও পড়ুন: ১২ ব্যাংকের অবস্থা ‌খুবই খারাপ, ৯টিতে জ্বলছে লাল বাতি!

গত অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আমদানি ১৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। টানা দুই অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনার প্রভাবে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমে এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ সময়ে দেশের রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থবছরের সাত মাসে রেমিট্যান্সে ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমদানি কমিয়ে আনা এবং রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কারণে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। জানুয়ারি শেষে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে চলতি হিসাবে ৪ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হিসাব অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সার্বিক আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ কমে ৩০৫ কোটি ডলারে নেমেছে। একই সময়ে রপ্তানি শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে ২৫৯ কোটি ডলার হয়েছে। এতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে ৪৫৯ কোটি ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ২৩১ কোটি ডলার।

আর্থিক হিসাবের অন্যতম উপাদান হলো বিদেশি বিনিয়োগ। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ১৮২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৮ শতাংশ কম। এ সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ৯৫ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। ফলে গত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ৫৩৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা জুলাই-নভেম্বর সময়ে ছিল ৫৪৮ কোটি ডলার। এদিকে গত ডিসেম্বর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ৬৪৫ কোটি ডলার।

ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের রেকর্ড ঘাটতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে এর আগে গভর্নরসহ নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। ঘাটতি কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও জানানো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়েছিল, জাতীয় নির্বাচনের পর ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি কমে আসবে। কিন্তু জানুয়ারির পরিসংখ্যান বিপরীত তথ্যই দিচ্ছে।

ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতির অর্থ হলো দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। গুরুত্বপূর্ণ এ হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় থামানো যাচ্ছে না। আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ অ্যাসেট বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সহায়তা, সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধ, বাণিজ্যিক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ট্রেড ক্রেডিট বা রফতানির বিপরীতে অপ্রত্যাবাসিত অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদ ও দায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত দেশে ডলারপ্রবাহের প্রায় সবক’টি খাতই সংকুচিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘দুর্বল ব্যাংকের তালিকা নিজস্ব রিসার্সের জন্য করা হয়েছে’

কোনো দেশে আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা বাড়া বা কমার বিষয়টি পরিমাপ করা হয় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। এ হিসাবে ঘাটতি তৈরি হলে দেশের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়ে। চলতি শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশের আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত ছিল। বিশেষ করে ২০১০ সাল-পরবর্তী এক যুগে কখনই ঘাটতি দেখা যায়নি। কিন্তু ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। গত অর্থবছর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১৪ কোটি ২০ লাখ ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরেও আর্থিক হিসাবে ১ হাজার ৪০৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে ৮৬৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫১৩ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯০১ কোটি ১০ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪২৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

বিজনেস জার্নাল/এসআর