১২:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

শিশুর নৈতিকতা বিকাশে অভিভাবকের ভূমিকা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৩:৪৫:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২১
  • / ৪১৩২ বার দেখা হয়েছে

কোনো জাতি ধ্বংস হওয়ার আগে তাদের সন্তানদের শৈশব ধ্বংস হয়ে যাবে। যত কাল পর্যন্ত কোনো জাতির শিশুদের কৈশোর ও তারুণ্য নিরাপদ থাকবে, তত দিন সে জাতি উন্নতি করতে থাকবে। হজরত নুহ (আ.) বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! পৃথিবীতে অকৃতজ্ঞদের একটি গৃহও রেখো না। যদি তুমি তাদের ছেড়ে দাও, তবে তারা তোমার বান্দাদের বিপথগামী করবে এবং তারা অপরাধী ও পাপী সন্তানই জন্ম দেবে।’ (সুরা-৭১ নুহ, আয়াত: ২৬-২৭)। তারা পাপী–বিপথগামী হলেও যদি তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তবে সে জাতি সমূলে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যেত। তাই আমাদের মানবসভ্যতার রক্ষার জন্য শিশুদের শৈশবকে পঙ্কিলতা ও আবিলতামুক্ত রাখতে হবে। সভ্যতার উন্নয়নের জন্য আমাদের শিশুদের উন্নত চিন্তা ও পবিত্র জীবনের দীক্ষা দিতে হবে।

সন্তানের শৈশব সুন্দর হলে সে ইহকাল ও পরকালে গর্বের ধন হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা এমন নারীদের বিয়ে করো, যারা অধিক সন্তানপ্রিয়। আমি তোমাদের সুসন্তানের জন্য রোজ কিয়ামতে গর্বিত হব।’ (নাসায়ি: ৩২২৭, আবুদাউদ: ২০৫০)।

আল্লাহ তাআলা অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া ও শুভকামনা শিখিয়েছেন। ‘হে আমার প্রভু! আমাকে সুসন্তান দান করুন।’ (সুরা-৩৭ ছফফাত, আয়াত: ১০০)। ‘হে আমার প্রভু! আমাদের সাথিদের ও আমাদের সন্তানদের আমাদের জন্য চোখের শীতলতায় পরিণত করুন, আর আমাদিগকে মুত্তাকিনদের প্রধান করুন।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২৫)। ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের উভয়কে আপনার অনুগত করুন, আর আমাদের বংশধরদিগকেও আপনার অনুগত করুন; আপনার বিধান আমাদের প্রত্যক্ষ করান এবং আমাদের প্রতি মনোনিবেশ করুন! নিশ্চয়ই আপনি তওবা কবুলকারী ও দয়ালু।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৮)।

সন্তান যেন বার্ধক্যে পিতা–মাতাকে নিঃসঙ্গ ফেলে না রাখে, সে জন্য প্রার্থনা, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে একা ছেড়ে দেবেন না, আপনিই তো সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী দাতা।’ (সুরা: আম্বিয়া, আয়াত: ৮৯)। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন উত্তম পারিবারিক পরিবেশ। আল্লাহ তাআলা তা–ও বলে দিলেন, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে উত্তম পরিবার দান করুন, নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৩৮)। ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের ইহকালে ও পরকালে কল্যাণ দান করুন, আর দোজখের আজাব হতে আমাদের রক্ষা করুন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২০১)।

কোনো শিশু যদি অভিভাবকের অবহেলার কারণে পথচ্যুত হয়ে যায়, তাহলে সে হাশরের দিনে আল্লাহর কাছে সেই অভিভাবকের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করবে, ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের অভিভাবক ও বড়দের অনুসরণ করেছি, তারা আমাদের বিপথগামী করেছে। হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা অভিসম্পাত করুন।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৬৭-৬৮)। তারা আরও বলবে, ‘হে আমাদের প্রভু! যে সকল জিন ও ইনসান আমাদের বিপথগামী করেছে, তাদেরকে আমাদের সামনে আনয়ন করে প্রকাশ করুন। আমরা তাদিগকে আমাদের পদতলে পিষ্ট করব, যাতে তারা হীন লাঞ্ছিত অপমানিত হয়।’ (সুরা ৪১ হা-মিম আস সাজদাহ, আয়াত: ২৯)।

শিশুর নৈতিক শিক্ষার সব ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তার দুনিয়া ও আখিরাত মঙ্গলময় হয়। শিশুকে শিষ্টাচার শেখাতে হবে, যাতে তার আচার–আচরণ সুন্দর হয় এবং সমাজে সবার ভালোবাসা ও সহানুভূতি লাভ করে। শিশুকে ভালো–মন্দ, ন্যায়–অন্যায়, কল্যাণ ও অকল্যাণ বোঝাতে হবে, যাতে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, নামাজসহ ইবাদতে অভ্যস্ত করতে হবে, যাতে মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। কোরআন, হাদিস ও ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মীয় সাহিত্য পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত মনীষীদের গল্প শোনাতে হবে। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বোঝাতে হবে। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী ও সমাজের সবার সঙ্গে মেশার সুযোগ তৈরি করতে হবে। খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের চর্চা বাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের স্নেহ করো এবং তাদের ভালো ব্যবহার শেখাও।’ (বুখারি)। ‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান–খয়রাতের চেয়েও উত্তম।’ (ইবনে মাজাহ)।

সন্তানদের নিরাপদ ও আনন্দময় শৈশবের জন্য পিতা–মাতা, অভিভাবকসহ শিক্ষক–শিক্ষিকা এবং সব স্তরের সচেতন নাগরিকেরই দায়িত্ব পালন করতে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর এ ব্যাপারে প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে।’ (বুখারি)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি কাজের প্রতিদান পেতে থাকে। এমন দান যার কল্যাণ চলমান থাকে, এমন জ্ঞান যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে, এমন সৎকর্মশীল সন্তান, যে তার (পিতা–মাতা ও অভিভাবকের) জন্য দোয়া করে।’ (ইবনে কাসির)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

শেয়ার করুন

x
English Version

শিশুর নৈতিকতা বিকাশে অভিভাবকের ভূমিকা

আপডেট: ০৩:৪৫:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২১

কোনো জাতি ধ্বংস হওয়ার আগে তাদের সন্তানদের শৈশব ধ্বংস হয়ে যাবে। যত কাল পর্যন্ত কোনো জাতির শিশুদের কৈশোর ও তারুণ্য নিরাপদ থাকবে, তত দিন সে জাতি উন্নতি করতে থাকবে। হজরত নুহ (আ.) বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! পৃথিবীতে অকৃতজ্ঞদের একটি গৃহও রেখো না। যদি তুমি তাদের ছেড়ে দাও, তবে তারা তোমার বান্দাদের বিপথগামী করবে এবং তারা অপরাধী ও পাপী সন্তানই জন্ম দেবে।’ (সুরা-৭১ নুহ, আয়াত: ২৬-২৭)। তারা পাপী–বিপথগামী হলেও যদি তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, তবে সে জাতি সমূলে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যেত। তাই আমাদের মানবসভ্যতার রক্ষার জন্য শিশুদের শৈশবকে পঙ্কিলতা ও আবিলতামুক্ত রাখতে হবে। সভ্যতার উন্নয়নের জন্য আমাদের শিশুদের উন্নত চিন্তা ও পবিত্র জীবনের দীক্ষা দিতে হবে।

সন্তানের শৈশব সুন্দর হলে সে ইহকাল ও পরকালে গর্বের ধন হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা এমন নারীদের বিয়ে করো, যারা অধিক সন্তানপ্রিয়। আমি তোমাদের সুসন্তানের জন্য রোজ কিয়ামতে গর্বিত হব।’ (নাসায়ি: ৩২২৭, আবুদাউদ: ২০৫০)।

আল্লাহ তাআলা অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া ও শুভকামনা শিখিয়েছেন। ‘হে আমার প্রভু! আমাকে সুসন্তান দান করুন।’ (সুরা-৩৭ ছফফাত, আয়াত: ১০০)। ‘হে আমার প্রভু! আমাদের সাথিদের ও আমাদের সন্তানদের আমাদের জন্য চোখের শীতলতায় পরিণত করুন, আর আমাদিগকে মুত্তাকিনদের প্রধান করুন।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২৫)। ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের উভয়কে আপনার অনুগত করুন, আর আমাদের বংশধরদিগকেও আপনার অনুগত করুন; আপনার বিধান আমাদের প্রত্যক্ষ করান এবং আমাদের প্রতি মনোনিবেশ করুন! নিশ্চয়ই আপনি তওবা কবুলকারী ও দয়ালু।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৮)।

সন্তান যেন বার্ধক্যে পিতা–মাতাকে নিঃসঙ্গ ফেলে না রাখে, সে জন্য প্রার্থনা, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে একা ছেড়ে দেবেন না, আপনিই তো সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী দাতা।’ (সুরা: আম্বিয়া, আয়াত: ৮৯)। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন উত্তম পারিবারিক পরিবেশ। আল্লাহ তাআলা তা–ও বলে দিলেন, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে উত্তম পরিবার দান করুন, নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৩৮)। ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের ইহকালে ও পরকালে কল্যাণ দান করুন, আর দোজখের আজাব হতে আমাদের রক্ষা করুন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২০১)।

কোনো শিশু যদি অভিভাবকের অবহেলার কারণে পথচ্যুত হয়ে যায়, তাহলে সে হাশরের দিনে আল্লাহর কাছে সেই অভিভাবকের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করবে, ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের অভিভাবক ও বড়দের অনুসরণ করেছি, তারা আমাদের বিপথগামী করেছে। হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা অভিসম্পাত করুন।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৬৭-৬৮)। তারা আরও বলবে, ‘হে আমাদের প্রভু! যে সকল জিন ও ইনসান আমাদের বিপথগামী করেছে, তাদেরকে আমাদের সামনে আনয়ন করে প্রকাশ করুন। আমরা তাদিগকে আমাদের পদতলে পিষ্ট করব, যাতে তারা হীন লাঞ্ছিত অপমানিত হয়।’ (সুরা ৪১ হা-মিম আস সাজদাহ, আয়াত: ২৯)।

শিশুর নৈতিক শিক্ষার সব ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তার দুনিয়া ও আখিরাত মঙ্গলময় হয়। শিশুকে শিষ্টাচার শেখাতে হবে, যাতে তার আচার–আচরণ সুন্দর হয় এবং সমাজে সবার ভালোবাসা ও সহানুভূতি লাভ করে। শিশুকে ভালো–মন্দ, ন্যায়–অন্যায়, কল্যাণ ও অকল্যাণ বোঝাতে হবে, যাতে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, নামাজসহ ইবাদতে অভ্যস্ত করতে হবে, যাতে মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। কোরআন, হাদিস ও ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মীয় সাহিত্য পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত মনীষীদের গল্প শোনাতে হবে। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বোঝাতে হবে। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী ও সমাজের সবার সঙ্গে মেশার সুযোগ তৈরি করতে হবে। খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের চর্চা বাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের স্নেহ করো এবং তাদের ভালো ব্যবহার শেখাও।’ (বুখারি)। ‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান–খয়রাতের চেয়েও উত্তম।’ (ইবনে মাজাহ)।

সন্তানদের নিরাপদ ও আনন্দময় শৈশবের জন্য পিতা–মাতা, অভিভাবকসহ শিক্ষক–শিক্ষিকা এবং সব স্তরের সচেতন নাগরিকেরই দায়িত্ব পালন করতে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর এ ব্যাপারে প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে।’ (বুখারি)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি কাজের প্রতিদান পেতে থাকে। এমন দান যার কল্যাণ চলমান থাকে, এমন জ্ঞান যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে, এমন সৎকর্মশীল সন্তান, যে তার (পিতা–মাতা ও অভিভাবকের) জন্য দোয়া করে।’ (ইবনে কাসির)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]