০৭:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

কী হলো সাকিব আল হাসানের!

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৫:৫০:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১
  • / ৪২৩৩ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ক্রিকেটের রাজপুত্র তিনি, পোস্টার বয় বা নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের যতটুকু অর্জন আছে, সেখানে সাকিব আল হাসানের নিবেদন অস্বীকার করার উপায় নেই! সবচেয়ে বড় সমালোচকটিও আলাদা দৃষ্টি রাখেন সাকিবে, তার মাঠের পারফরম্যান্সে। আপনি সাকিবের সমালোচক হতেই পারেন, সেজন্য তাকে জানতে হবে সবার আগে। জানতে হবে সাকিবকে, চোখ রাখতে হবে তার পরিসংখ্যানে।

‘সাকিব হাসলে হাসে বাংলাদেশ’- বলতেই পারেন, তবে ওই সময় পার করে এসেছে এদেশের ক্রিকেট। তবে এত বছর পরও একজন সাকিবের বিকল্প পেয়েছে কি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা? এতে অবশ্য রেকর্ড বই উল্টানোর প্রয়োজন নেই। জোর গলায় বলতে পারেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের বিকল্প তৈরি হয়নি এখনো। 

বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্থানীয় এক কোচ তো আক্ষেপ নিয়েই বলছিলেন, ‘সব তরুণ ক্রিকেটারই চায় সাকিবের মতো হতে। সাকিবের ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা নেই কারও।’

ছোটবেলায় শোনা সেই ‘হাতি আর দড়ি—নিজের উপর বিশ্বাসের গল্প’ মনে আছে? মনে না থাকলে একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

একজন ভদ্রলোক একবার একটা হাতির ক্যাম্পে প্রবেশ করেছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন অনেকগুলো হাতি আছে সেখানে কিন্তু একটা হাতিও কোনো খাঁচার ভিতরে নাই এবং কোনো হাতিই লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা না। বরং হাতিগুলোকে তাদের পায়ে ছোট্ট একটা দড়ি দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। এটা দেখে ভদ্রলোক খুব বিস্মিত হলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন এই বিশাল বিশাল হাতিগুলোর জন্য এই দড়ি ছিঁড়ে পালানো তো কোনো ঘটনাই না, তবু ঠিক কী কারণে এরা সেই চেষ্টাটাও করছে না!

প্রচণ্ড কৌতূহলী হয়ে সেই লোক ক্যাম্পের একজন ট্রেনারকে খুঁজে বের করলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন ঠিক কী কারণে হাতিগুলো কখনোই দড়ি ছিঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে না? ট্রেনার তখন উত্তর দিলেন, এই হাতিগুলো যখন খুব ছোট ছিল তখন আমরা এই একই সাইজের দড়ি দিয়ে তাদেরকে বেঁধে রাখতাম। তখন এই দড়িই হাতিগুলোকে বেঁধে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। তারা বিশ্বাস করতে করতে বড় হয়েছে যে এটা ছিঁড়ে বের হতে পারবে না। তাই, তারা এখনো বিশ্বাস করে এই দড়ি তাদেরকে এখনো আটকে রাখতে পারে, এই কারণে তারা এটা ছিঁড়ে বের হওয়ারও চেষ্টা করে না।

নির্মম বাস্তবতা হাতি আর দড়ির গল্পের মতোই। আমাদের তরুণ কোনও ক্রিকেটার এটা বিশ্বাস করতেই পারেন না যে, সাকিবকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এর ছাপ স্পষ্ট। দিনশেষে একজন সাকিবের বিকল্প পাবেন কোথায়?

নিষেধাজ্ঞার আগের সাকিব আর নিষেধাজ্ঞার পরের সাকিবের মধ্যে বিস্তত ফারাক। মাঠের ক্রিকেট, পরিসংখ্যান সবই সে কথা বলছে। এক বছরের সাজা শেষে মাঠে ফিরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে কিছুটা চনমনে সাকিবকে দেখা গেলেও সময় যত গড়াচ্ছে কুপির সলতের মতোই যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে তার ব্যাটের তেজ। বোলিংয়েও যে লেটার মার্ক দিবেন, সে ভাবনাটাও বাড়াবাড়ি বৈকি!

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ চলাকালীন চোট। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ছুটি। নিউজিল্যান্ড সফরে গেলেন না সাকিব। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে গেলেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলতে। সেখানে ৩ ম্যাচ খেলে একাদশে জায়গা হারালেন। সে তিন ম্যাচে ব্যাট থেকে আসলো মোটে ৩৮ রান!

এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে তার ব্যাট থেকে আসে মাত্র ১৯ রান। রান পাননি ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগেও। ৮ ম্যচে সর্বসাকুল্য ১২০ রান করেন তিনি। কোথাও নেই একটি পঞ্চাশ ঊর্ধ্বো ইনিংস! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৭৪ রান করলেও একমাত্র টেস্টে ব্যাট করতে নেমে ৩ রান করে আউট হন। ব্যাট হাতে এমন হতশ্রী সময় শেষ কবে কাটিয়েছেন সাকিব?

ক্রিকেটারদের টেকনিক্যাল ও মানসিক দিকগুলোতে উন্নতি সাধনের জন্য টোটকা দেয়ার জন্য বিখ্যাত নাজমুল আবেদীন ফাহিম। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিকেএসপিতে  ক্রিকেট কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল বিসিবির গেম ডেভলপমেন্ট বিভাগে কাজ করে দেশের ক্রিকেটের পাইপলাইন সমৃদ্ধ করেছেন। ক্রিকেটাররা যখন কোন সমস্যায় কিংবা বাজে ফর্মে থাকেন, তখন তারা ফাহিম স্যার এর শরণ নেন। সাকিবও এর ব্যতিক্রম নন। 

কোথায় সমস্যা হচ্ছে সাকিবের? নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, ‘ওর ব্যাটিংয়ের কিছুটা অসুবিধা তো হচ্ছেই। আমরা ওর ব্যাটিং যেভাবে দেখে অভ্যস্ত, সেভাবে ঠিক হচ্ছে না। কোথাও একটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। সে নিজেও এই জিনিসটা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। আমার মনে হয় এজন্যই ও সময় নিয়ে ব্যাটিং করছে বোঝার জন্য। সে নিজের ব্যাটিংটা বুঝতে পারে সেই চেষ্টাই করছে।’

ফাহিমের টোটকা, ‘ইদানিং লক্ষ্য করছি ও শুরুতেই আক্রমনাত্মক খেলার চেষ্টা করছে। এটা ভালো ফল দিচ্ছে না। সে প্রতি ইনিংসে এভাবেই আউট হচ্ছে। যখন বড় শটস খেলতে যাচ্ছে, তখনই কিন্তু আউট হচ্ছে বেশি। আমার মনেহয় এ জায়গায় একটু মনঃসংযোগ ধরে রাখতে হবে। তার কোচরা আছে, তাদের সাথে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।’

‘জীবনে ভালো দিন, খারাপ দিন দুটোই থাকবে। তোমার কাজ হবে সামনে এগিয়ে যাওয়া।’- উসাইন বোল্টের ভাষার বলতে গেলে, প্রতিটি খেলোয়াড়ের সুদিন আসে, দুর্দিনেরও সঙ্গী হতে হয়। নিষেধাজ্ঞার ঠিক আগে, ২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে তো রীতিমতো বাজিমাত করেন সাকিব। ৮ ম্যাচে প্রায় ৮৭ গড়ে ৬০৬ রান করেন তিনি। ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তৃতীয় স্থানে। যেখানে টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৫টি ফিফটির সঙ্গে ২টি সেঞ্চুরিও করেন সাকিব।

তবে কি ব্যাট হাতে সুদিন পিছনে ফেলে এসেছেন তিনি? ফাহিম অবশ্য যুক্তি দিয়ে বোঝালেন সেদিন এখনো আসেনি সাকিবের, ‘আমার মনে হয় না সে ব্যাটিংয়ে তার সেরা সময়টা ফেলে এসেছে। সেরা সময় তো তখনই শেষ হয়ে যায় যখন তার সক্ষমতা থাকে না, তার ফিটনেস থাকে না। তখন আমরা বলতে পারব সাকিবের ব্যাটিংটা আর আগের মতো নেই। সাকিব কিন্তু এখনো সেই জায়গাতে আসেনি। সে এখনো যথেষ্ট পরিমান ফিট এবং প্রতিবার ব্যাটিংয়ে নামর পর তার রানের ক্ষুধা কতটা। আমার মনে হয় কোন টেকনিক্যাল কারণে এমনটা হচ্ছে। সেটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই আবার পুরনো সাকিবকে দেখা যাবে।’

একটি বিষয় লক্ষণীয়, সাকিব মাঠের পারফরম্যান্স ধরে রাখতে অনুশীলনে বাড়তি সময় দিচ্ছেন। সুযোগ পেলেই ব্যাট হাতে নেমে যাচ্ছেন নেটে। তবে মাঠের বাইরের খেলাটাও নেহায়েত মন্দ খেলছেন না। সম্প্রতি যে চাপা আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট, তার শুরুটা সাকিবের হাত ধরেই। সে জল তো অনেকদূর গড়িয়েছে, অজানা নয় কারও।

সাকিবের কি তবে মাঠের বাইরের খেলাতেই বাড়তি মনোযোগ?- সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই।

সাকিব বাংলাদেশে থাকলেও তার পরিবার থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। স্ত্রী আর তিন সন্তান আছে সেখানে। নিষেধাজ্ঞা শেষ করে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন সাকিব। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে ছুটে যান ২২ ফেব্রুয়ারি। আবার ফেরেন ২৩ মার্চ। মাঝে জিম্বাবুয়ে সফরের আগে গিয়ে থেকে এসেছেন আরও ১২ দিন। সর্বসাকুল্য ৪০ দিনের মতো ছুটিতে দেশে ছিলেন না টাইগার অলরাউন্ডার। বাকি সময়গুলো অবশ্য কেটেছে কোয়ারেন্টানই, খেলা আর জৈব সুরক্ষা বলয়ে। 

এসবই এক চাপ তৈরি করছে সাকিবের? তার কি একান্ত নিজের মতো কিছু সময়ের প্রয়োজন? ফাহিম অবশ্য তেমনটা মনে করছেন না, ‘আমার মনে হয় না ওর কোন বিশ্রামের দরকার আছে। সে নিজেও জানে তাকে রানে ফিরতে হলে কি করতে হবে। যতদিন না রানে ফিরছে, সে নিজেও কোন স্বস্তি পাবে বলে মনে হয় না। আমার মনেহয় মাঠে থেকে ম্যাচ খেলেই রান খরা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। যত বেশি ম্যাচ খেলবে তত সহজ হবে ওর জন্য।’

তবে দিন শেষে বাস্তবতা আমলে নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান একজনই। তিনি যত দ্রুত স্বরূপে ফিরবেন, আখেরে লাভ এদেশের ক্রিকেটেরই।

ঢাকা/এনইউ

আরও পড়ুন:

শেয়ার করুন

x
English Version

কী হলো সাকিব আল হাসানের!

আপডেট: ০৫:৫০:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ক্রিকেটের রাজপুত্র তিনি, পোস্টার বয় বা নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের যতটুকু অর্জন আছে, সেখানে সাকিব আল হাসানের নিবেদন অস্বীকার করার উপায় নেই! সবচেয়ে বড় সমালোচকটিও আলাদা দৃষ্টি রাখেন সাকিবে, তার মাঠের পারফরম্যান্সে। আপনি সাকিবের সমালোচক হতেই পারেন, সেজন্য তাকে জানতে হবে সবার আগে। জানতে হবে সাকিবকে, চোখ রাখতে হবে তার পরিসংখ্যানে।

‘সাকিব হাসলে হাসে বাংলাদেশ’- বলতেই পারেন, তবে ওই সময় পার করে এসেছে এদেশের ক্রিকেট। তবে এত বছর পরও একজন সাকিবের বিকল্প পেয়েছে কি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা? এতে অবশ্য রেকর্ড বই উল্টানোর প্রয়োজন নেই। জোর গলায় বলতে পারেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের বিকল্প তৈরি হয়নি এখনো। 

বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্থানীয় এক কোচ তো আক্ষেপ নিয়েই বলছিলেন, ‘সব তরুণ ক্রিকেটারই চায় সাকিবের মতো হতে। সাকিবের ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা নেই কারও।’

ছোটবেলায় শোনা সেই ‘হাতি আর দড়ি—নিজের উপর বিশ্বাসের গল্প’ মনে আছে? মনে না থাকলে একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

একজন ভদ্রলোক একবার একটা হাতির ক্যাম্পে প্রবেশ করেছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন অনেকগুলো হাতি আছে সেখানে কিন্তু একটা হাতিও কোনো খাঁচার ভিতরে নাই এবং কোনো হাতিই লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা না। বরং হাতিগুলোকে তাদের পায়ে ছোট্ট একটা দড়ি দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। এটা দেখে ভদ্রলোক খুব বিস্মিত হলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন এই বিশাল বিশাল হাতিগুলোর জন্য এই দড়ি ছিঁড়ে পালানো তো কোনো ঘটনাই না, তবু ঠিক কী কারণে এরা সেই চেষ্টাটাও করছে না!

প্রচণ্ড কৌতূহলী হয়ে সেই লোক ক্যাম্পের একজন ট্রেনারকে খুঁজে বের করলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন ঠিক কী কারণে হাতিগুলো কখনোই দড়ি ছিঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে না? ট্রেনার তখন উত্তর দিলেন, এই হাতিগুলো যখন খুব ছোট ছিল তখন আমরা এই একই সাইজের দড়ি দিয়ে তাদেরকে বেঁধে রাখতাম। তখন এই দড়িই হাতিগুলোকে বেঁধে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। তারা বিশ্বাস করতে করতে বড় হয়েছে যে এটা ছিঁড়ে বের হতে পারবে না। তাই, তারা এখনো বিশ্বাস করে এই দড়ি তাদেরকে এখনো আটকে রাখতে পারে, এই কারণে তারা এটা ছিঁড়ে বের হওয়ারও চেষ্টা করে না।

নির্মম বাস্তবতা হাতি আর দড়ির গল্পের মতোই। আমাদের তরুণ কোনও ক্রিকেটার এটা বিশ্বাস করতেই পারেন না যে, সাকিবকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এর ছাপ স্পষ্ট। দিনশেষে একজন সাকিবের বিকল্প পাবেন কোথায়?

নিষেধাজ্ঞার আগের সাকিব আর নিষেধাজ্ঞার পরের সাকিবের মধ্যে বিস্তত ফারাক। মাঠের ক্রিকেট, পরিসংখ্যান সবই সে কথা বলছে। এক বছরের সাজা শেষে মাঠে ফিরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে কিছুটা চনমনে সাকিবকে দেখা গেলেও সময় যত গড়াচ্ছে কুপির সলতের মতোই যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে তার ব্যাটের তেজ। বোলিংয়েও যে লেটার মার্ক দিবেন, সে ভাবনাটাও বাড়াবাড়ি বৈকি!

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ চলাকালীন চোট। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ছুটি। নিউজিল্যান্ড সফরে গেলেন না সাকিব। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে গেলেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলতে। সেখানে ৩ ম্যাচ খেলে একাদশে জায়গা হারালেন। সে তিন ম্যাচে ব্যাট থেকে আসলো মোটে ৩৮ রান!

এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে তার ব্যাট থেকে আসে মাত্র ১৯ রান। রান পাননি ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগেও। ৮ ম্যচে সর্বসাকুল্য ১২০ রান করেন তিনি। কোথাও নেই একটি পঞ্চাশ ঊর্ধ্বো ইনিংস! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৭৪ রান করলেও একমাত্র টেস্টে ব্যাট করতে নেমে ৩ রান করে আউট হন। ব্যাট হাতে এমন হতশ্রী সময় শেষ কবে কাটিয়েছেন সাকিব?

ক্রিকেটারদের টেকনিক্যাল ও মানসিক দিকগুলোতে উন্নতি সাধনের জন্য টোটকা দেয়ার জন্য বিখ্যাত নাজমুল আবেদীন ফাহিম। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিকেএসপিতে  ক্রিকেট কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল বিসিবির গেম ডেভলপমেন্ট বিভাগে কাজ করে দেশের ক্রিকেটের পাইপলাইন সমৃদ্ধ করেছেন। ক্রিকেটাররা যখন কোন সমস্যায় কিংবা বাজে ফর্মে থাকেন, তখন তারা ফাহিম স্যার এর শরণ নেন। সাকিবও এর ব্যতিক্রম নন। 

কোথায় সমস্যা হচ্ছে সাকিবের? নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, ‘ওর ব্যাটিংয়ের কিছুটা অসুবিধা তো হচ্ছেই। আমরা ওর ব্যাটিং যেভাবে দেখে অভ্যস্ত, সেভাবে ঠিক হচ্ছে না। কোথাও একটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। সে নিজেও এই জিনিসটা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। আমার মনে হয় এজন্যই ও সময় নিয়ে ব্যাটিং করছে বোঝার জন্য। সে নিজের ব্যাটিংটা বুঝতে পারে সেই চেষ্টাই করছে।’

ফাহিমের টোটকা, ‘ইদানিং লক্ষ্য করছি ও শুরুতেই আক্রমনাত্মক খেলার চেষ্টা করছে। এটা ভালো ফল দিচ্ছে না। সে প্রতি ইনিংসে এভাবেই আউট হচ্ছে। যখন বড় শটস খেলতে যাচ্ছে, তখনই কিন্তু আউট হচ্ছে বেশি। আমার মনেহয় এ জায়গায় একটু মনঃসংযোগ ধরে রাখতে হবে। তার কোচরা আছে, তাদের সাথে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।’

‘জীবনে ভালো দিন, খারাপ দিন দুটোই থাকবে। তোমার কাজ হবে সামনে এগিয়ে যাওয়া।’- উসাইন বোল্টের ভাষার বলতে গেলে, প্রতিটি খেলোয়াড়ের সুদিন আসে, দুর্দিনেরও সঙ্গী হতে হয়। নিষেধাজ্ঞার ঠিক আগে, ২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে তো রীতিমতো বাজিমাত করেন সাকিব। ৮ ম্যাচে প্রায় ৮৭ গড়ে ৬০৬ রান করেন তিনি। ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তৃতীয় স্থানে। যেখানে টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৫টি ফিফটির সঙ্গে ২টি সেঞ্চুরিও করেন সাকিব।

তবে কি ব্যাট হাতে সুদিন পিছনে ফেলে এসেছেন তিনি? ফাহিম অবশ্য যুক্তি দিয়ে বোঝালেন সেদিন এখনো আসেনি সাকিবের, ‘আমার মনে হয় না সে ব্যাটিংয়ে তার সেরা সময়টা ফেলে এসেছে। সেরা সময় তো তখনই শেষ হয়ে যায় যখন তার সক্ষমতা থাকে না, তার ফিটনেস থাকে না। তখন আমরা বলতে পারব সাকিবের ব্যাটিংটা আর আগের মতো নেই। সাকিব কিন্তু এখনো সেই জায়গাতে আসেনি। সে এখনো যথেষ্ট পরিমান ফিট এবং প্রতিবার ব্যাটিংয়ে নামর পর তার রানের ক্ষুধা কতটা। আমার মনে হয় কোন টেকনিক্যাল কারণে এমনটা হচ্ছে। সেটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই আবার পুরনো সাকিবকে দেখা যাবে।’

একটি বিষয় লক্ষণীয়, সাকিব মাঠের পারফরম্যান্স ধরে রাখতে অনুশীলনে বাড়তি সময় দিচ্ছেন। সুযোগ পেলেই ব্যাট হাতে নেমে যাচ্ছেন নেটে। তবে মাঠের বাইরের খেলাটাও নেহায়েত মন্দ খেলছেন না। সম্প্রতি যে চাপা আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট, তার শুরুটা সাকিবের হাত ধরেই। সে জল তো অনেকদূর গড়িয়েছে, অজানা নয় কারও।

সাকিবের কি তবে মাঠের বাইরের খেলাতেই বাড়তি মনোযোগ?- সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই।

সাকিব বাংলাদেশে থাকলেও তার পরিবার থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। স্ত্রী আর তিন সন্তান আছে সেখানে। নিষেধাজ্ঞা শেষ করে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন সাকিব। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে ছুটে যান ২২ ফেব্রুয়ারি। আবার ফেরেন ২৩ মার্চ। মাঝে জিম্বাবুয়ে সফরের আগে গিয়ে থেকে এসেছেন আরও ১২ দিন। সর্বসাকুল্য ৪০ দিনের মতো ছুটিতে দেশে ছিলেন না টাইগার অলরাউন্ডার। বাকি সময়গুলো অবশ্য কেটেছে কোয়ারেন্টানই, খেলা আর জৈব সুরক্ষা বলয়ে। 

এসবই এক চাপ তৈরি করছে সাকিবের? তার কি একান্ত নিজের মতো কিছু সময়ের প্রয়োজন? ফাহিম অবশ্য তেমনটা মনে করছেন না, ‘আমার মনে হয় না ওর কোন বিশ্রামের দরকার আছে। সে নিজেও জানে তাকে রানে ফিরতে হলে কি করতে হবে। যতদিন না রানে ফিরছে, সে নিজেও কোন স্বস্তি পাবে বলে মনে হয় না। আমার মনেহয় মাঠে থেকে ম্যাচ খেলেই রান খরা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। যত বেশি ম্যাচ খেলবে তত সহজ হবে ওর জন্য।’

তবে দিন শেষে বাস্তবতা আমলে নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান একজনই। তিনি যত দ্রুত স্বরূপে ফিরবেন, আখেরে লাভ এদেশের ক্রিকেটেরই।

ঢাকা/এনইউ

আরও পড়ুন: