১০:৫৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

৭ মার্চের শিক্ষা হোক দীপ্ত শপথ

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৫:৩৫:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মার্চ ২০২১
  • / ৪১৪২ বার দেখা হয়েছে

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঢাকাস্থ রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাত্র ১৯ মিনিটের একটি ভাষণ সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহাকে চাঙ্গা করে দিয়েছিল। এ ভাষণই সেদিন সংশয়ে থাকা বাঙালির চোখে জ্বালিয়ে দিয়েছিল স্বপ্নের অমর জ্যোতি। দুনিয়া কাঁপানো ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম এ ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ৭১ সালের ২৬ মার্চ দেওয়া হলেও মূলত ৭ মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার বীজ বপনের দিন।

৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট ছিল সুদৃঢ় প্রসারী। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের প্রতিবাদ এবং বাঙালির মুক্তির পথ দেখানো ছিল এ ভাষণের মূল উপজীব্য। ৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহানা শুরু করে। শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরই নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানিদের এধরনের অনেকগুলো অন্যায় কাজের প্রতিবাদের কঠোর প্রকাশই ফুটে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোন পরিকল্পনায় হবে, বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোন উপায়ে প্রতিহত করবে, প্রতিরোধের ধরন এবং শিক্ষা কেমন হবে এবং কোন আদর্শিক মতাদর্শে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হবে তার পূর্ণাঙ্গ ছক চিত্রিত হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যে।

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও পূর্ব-পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে কোনো অংশ বাদ রাখেননি। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের শুরুতেই উপস্থিত জনসমুদ্রকে ‘প্রিয় ভাইয়েরা’ সম্বোধন করে আপন করে নেন। ১৯ মিনিট স্থায়ী বক্তৃৃতায় বঙ্গবন্ধু তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। একই সঙ্গে মুসলিম লীগের প্রধান হিসেবে তার নিজের ভূমিকা ও অবস্থান স্পষ্ট করেন। ৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন ও তার ফলাফল এবং পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ওপর একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের কাছে সামরিক আইন প্রত্যাহারসহ পূর্ব-পাকিস্তানিদের ওপর চালানো বর্বরোচিত অত্যাচার এবং সামরিক আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন- ‘যদি এ দাবি মেনে নেওয়া না হয় তবে সামগ্রিকভাবে অন্যায়ের মোকাবিলা করা হবে এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়া হবে’। বঙ্গবন্ধু- এ সর্বজনস্বীকৃত নামটা উচ্চারিত হলেই সবার হৃদয়ের মনিকোঠায় জেগে ওঠে বিনয়াবনত শ্রদ্ধা। যেন সবাই অন্তরচক্ষু দ্বারা অনুভব করে, তর্জনী উঁচু করে আজও বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করছেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ আজও শ্রবণ করলে রক্তের অনুরণন ঘটে। যতবার শুনি ততবার নতুন করে শিহরণ অনুভূত হয়, যতবার শুনি ততবার শিখি।

১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে শিখিয়েছিলেন সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা। দিয়েছিলেন ন্যায়ের পক্ষে জীবনবাজি রাখার প্রেরণা। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ বিশ্বের সকল বাঙালিকে তার অমোঘ ঘোষণার মাধ্যমে শিখিয়েছিলেন কীভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং অন্যায়কে প্রতিহত করতে হবে। বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন এই বলে- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে, তা দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করত হবে’। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জাতির জন্য শিক্ষা ছিল কীভাবে শত্রুদের মোকাবিলা করতে হবে- হোক সে বাইরের শত্রু কিংবা ঘরের শত্রু। ২. বাঙালিকে তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন শুধু মরণাস্ত্র দিয়ে শত্রুদের মোকাবিলা করা যায় না। শত্রুকে পরাজিত করার জন্য চাই অনেক কলাকৌশল। তাই তো স্বাধীনতার স্থপতি বলেছিলেন- ‘আমরা তাদেরকে ভাতে মারব, পানিতে মারব’। বঙ্গবন্ধুর বাতলে দেওয়া সে কৌশল অবলম্বন করেই স্বাধীনতা যোদ্ধারা অস্ত্রের বলে বলীয়ান পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রায় খালি হাতেই জয়ী হতে পেরেছিল।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শেখানো অনেক কৌশল প্রয়োগ করেছিল। তাইতো ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধকালে এদেশের মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীকে খাদ্যে কষ্ট দিয়েছে। এদেশের বিভিন্ন খাল, বিল ও নদীতে তাদের চুবিয়েছেও। ৩. বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে কোনো ধ্বংসাত্মক নির্দেশনা ছিল না। পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা ও শৃঙ্খলার স্বার্থে তিনি সর্বোচ্চ ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তার ভাষায়, ‘আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব’। ঐতিহাসিক এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শোষণ, নির্যাতন, হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন- ‘আমি বলেছি কীসের এসেম্বলি বসবে? কার সঙ্গে কথা বলব? আপনারা যারা আমার মানুষের রক্ত নিয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলব না’। ৪. সংখ্যাগুরু কর্তৃক সংখ্যালঘুদেরকে নির্যাতন এদেশের জন্য একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে বারবার তাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির খরা চলছে অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন- ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে- তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনার উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়’। ৫. বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের একেবারে শেষদিকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জাতিকে সাবধান করে বলেছিলেন- ‘যেন বন্ধুর বেশে শত্রু আমাদের অন্দরে প্রবেশ করে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে’। ‘শোনেন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে’। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তব্যে কোনো উসকানিমূলক কথা ছিল না। পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি তিনি বলেন- ‘সৈন্যরা, তোমরা আমাদের ভাই। তোমরা ব্যারাকে থাকো। তোমাদের কেউ কিছু বলবে না, কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা করো না’। অত্যন্ত সুন্দর, সাবলীল ভাষায় বঙ্গবন্ধু সেদিন বাংলার মানুষের তরে স্বাধীনতার পূর্বাভাস দিয়ে গেলেন।

যে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বুনতে সাহায্য করেছিল, এনে দিয়েছিল অমূল্য স্বাধীনতা, সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শুরু হয়েছে চরম দলীয়করণ অথচ বঙ্গবন্ধু কোনো দলের, ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি নন। তিনি সবার। প্রকৃত বিচারে ৭ মার্চের ভাষণের হাত ধরেই আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা, ভাষণটি স্থান পেয়েছে দুনিয়া কাঁপানো ভাষণগুলোর শীর্ষের দিকে। এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আজও পৃথিবীর কোনো নেতা সংক্ষিপ্ত সময়ে এত তাৎপর্যমণ্ডিত ভাষণ দিতে পারেননি। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা-ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’-এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। বস্তুতপক্ষে ৭ মার্চের ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। সুতরাং ৭ মার্চের ভাষণের প্রেরণায় উজ্জীবিত হোক গোটা দেশ, বাঙালি সমাজ।

স্বাধীনতা অর্জনের মানসে উৎসর্গিত ত্রিশ লাখ শহীদের বুকের তাজা খুন এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম যেন বৃথা না যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বাধীন দেশের ১৬ কোটি মানুষ যেন হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারি, এই হোক মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের শিক্ষায় হোক আমাদের দীপ্ত শপথ।

রিপন আহসান ঋতু : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

 

আরও পড়ু্ন:

শেয়ার করুন

x
English Version

৭ মার্চের শিক্ষা হোক দীপ্ত শপথ

আপডেট: ০৫:৩৫:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মার্চ ২০২১

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঢাকাস্থ রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাত্র ১৯ মিনিটের একটি ভাষণ সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহাকে চাঙ্গা করে দিয়েছিল। এ ভাষণই সেদিন সংশয়ে থাকা বাঙালির চোখে জ্বালিয়ে দিয়েছিল স্বপ্নের অমর জ্যোতি। দুনিয়া কাঁপানো ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম এ ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ৭১ সালের ২৬ মার্চ দেওয়া হলেও মূলত ৭ মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার বীজ বপনের দিন।

৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট ছিল সুদৃঢ় প্রসারী। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের প্রতিবাদ এবং বাঙালির মুক্তির পথ দেখানো ছিল এ ভাষণের মূল উপজীব্য। ৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে টালবাহানা শুরু করে। শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরই নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানিদের এধরনের অনেকগুলো অন্যায় কাজের প্রতিবাদের কঠোর প্রকাশই ফুটে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোন পরিকল্পনায় হবে, বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোন উপায়ে প্রতিহত করবে, প্রতিরোধের ধরন এবং শিক্ষা কেমন হবে এবং কোন আদর্শিক মতাদর্শে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হবে তার পূর্ণাঙ্গ ছক চিত্রিত হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যে।

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও পূর্ব-পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে কোনো অংশ বাদ রাখেননি। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের শুরুতেই উপস্থিত জনসমুদ্রকে ‘প্রিয় ভাইয়েরা’ সম্বোধন করে আপন করে নেন। ১৯ মিনিট স্থায়ী বক্তৃৃতায় বঙ্গবন্ধু তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। একই সঙ্গে মুসলিম লীগের প্রধান হিসেবে তার নিজের ভূমিকা ও অবস্থান স্পষ্ট করেন। ৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন ও তার ফলাফল এবং পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ওপর একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের কাছে সামরিক আইন প্রত্যাহারসহ পূর্ব-পাকিস্তানিদের ওপর চালানো বর্বরোচিত অত্যাচার এবং সামরিক আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন- ‘যদি এ দাবি মেনে নেওয়া না হয় তবে সামগ্রিকভাবে অন্যায়ের মোকাবিলা করা হবে এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়া হবে’। বঙ্গবন্ধু- এ সর্বজনস্বীকৃত নামটা উচ্চারিত হলেই সবার হৃদয়ের মনিকোঠায় জেগে ওঠে বিনয়াবনত শ্রদ্ধা। যেন সবাই অন্তরচক্ষু দ্বারা অনুভব করে, তর্জনী উঁচু করে আজও বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করছেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ আজও শ্রবণ করলে রক্তের অনুরণন ঘটে। যতবার শুনি ততবার নতুন করে শিহরণ অনুভূত হয়, যতবার শুনি ততবার শিখি।

১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে শিখিয়েছিলেন সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা। দিয়েছিলেন ন্যায়ের পক্ষে জীবনবাজি রাখার প্রেরণা। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ বিশ্বের সকল বাঙালিকে তার অমোঘ ঘোষণার মাধ্যমে শিখিয়েছিলেন কীভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং অন্যায়কে প্রতিহত করতে হবে। বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন এই বলে- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে, তা দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করত হবে’। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জাতির জন্য শিক্ষা ছিল কীভাবে শত্রুদের মোকাবিলা করতে হবে- হোক সে বাইরের শত্রু কিংবা ঘরের শত্রু। ২. বাঙালিকে তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন শুধু মরণাস্ত্র দিয়ে শত্রুদের মোকাবিলা করা যায় না। শত্রুকে পরাজিত করার জন্য চাই অনেক কলাকৌশল। তাই তো স্বাধীনতার স্থপতি বলেছিলেন- ‘আমরা তাদেরকে ভাতে মারব, পানিতে মারব’। বঙ্গবন্ধুর বাতলে দেওয়া সে কৌশল অবলম্বন করেই স্বাধীনতা যোদ্ধারা অস্ত্রের বলে বলীয়ান পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রায় খালি হাতেই জয়ী হতে পেরেছিল।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শেখানো অনেক কৌশল প্রয়োগ করেছিল। তাইতো ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধকালে এদেশের মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীকে খাদ্যে কষ্ট দিয়েছে। এদেশের বিভিন্ন খাল, বিল ও নদীতে তাদের চুবিয়েছেও। ৩. বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে কোনো ধ্বংসাত্মক নির্দেশনা ছিল না। পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা ও শৃঙ্খলার স্বার্থে তিনি সর্বোচ্চ ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তার ভাষায়, ‘আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব’। ঐতিহাসিক এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শোষণ, নির্যাতন, হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন- ‘আমি বলেছি কীসের এসেম্বলি বসবে? কার সঙ্গে কথা বলব? আপনারা যারা আমার মানুষের রক্ত নিয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলব না’। ৪. সংখ্যাগুরু কর্তৃক সংখ্যালঘুদেরকে নির্যাতন এদেশের জন্য একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে বারবার তাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির খরা চলছে অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন- ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে- তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনার উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়’। ৫. বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের একেবারে শেষদিকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জাতিকে সাবধান করে বলেছিলেন- ‘যেন বন্ধুর বেশে শত্রু আমাদের অন্দরে প্রবেশ করে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে’। ‘শোনেন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে’। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তব্যে কোনো উসকানিমূলক কথা ছিল না। পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি তিনি বলেন- ‘সৈন্যরা, তোমরা আমাদের ভাই। তোমরা ব্যারাকে থাকো। তোমাদের কেউ কিছু বলবে না, কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা করো না’। অত্যন্ত সুন্দর, সাবলীল ভাষায় বঙ্গবন্ধু সেদিন বাংলার মানুষের তরে স্বাধীনতার পূর্বাভাস দিয়ে গেলেন।

যে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বুনতে সাহায্য করেছিল, এনে দিয়েছিল অমূল্য স্বাধীনতা, সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শুরু হয়েছে চরম দলীয়করণ অথচ বঙ্গবন্ধু কোনো দলের, ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তি নন। তিনি সবার। প্রকৃত বিচারে ৭ মার্চের ভাষণের হাত ধরেই আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা, ভাষণটি স্থান পেয়েছে দুনিয়া কাঁপানো ভাষণগুলোর শীর্ষের দিকে। এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আজও পৃথিবীর কোনো নেতা সংক্ষিপ্ত সময়ে এত তাৎপর্যমণ্ডিত ভাষণ দিতে পারেননি। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা-ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’-এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। বস্তুতপক্ষে ৭ মার্চের ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। সুতরাং ৭ মার্চের ভাষণের প্রেরণায় উজ্জীবিত হোক গোটা দেশ, বাঙালি সমাজ।

স্বাধীনতা অর্জনের মানসে উৎসর্গিত ত্রিশ লাখ শহীদের বুকের তাজা খুন এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম যেন বৃথা না যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বাধীন দেশের ১৬ কোটি মানুষ যেন হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারি, এই হোক মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের শিক্ষায় হোক আমাদের দীপ্ত শপথ।

রিপন আহসান ঋতু : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

 

আরও পড়ু্ন: