১২:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসি’র আর্থিক কেলেঙ্কারি: দায় এড়াতে পারে না বিএসইসি

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৪:৫৩:১২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ অক্টোবর ২০২২
  • / ৪২৪২ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) থেকে অবৈধভাবে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে মোট ৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। এরমধ্যে শুধু ভারতে কারাবন্দি প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেই ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আর বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান ও তার প্রতিষ্ঠান বিআইএফসি থেকে নিয়ে গেছে ৬০০ কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে এই লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও নিশ্চুপ ছিলেন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকই নয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ, এবং অডিট ফার্মগুলোও এক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব্য পালন করেনি। নজিরবিহীন এই আর্থিক অনিয়মের কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির আলাদা তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ইতিমধ্যে মোট ১২শ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দুটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নজিরবিহীন এই লুটের ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটির মোট সম্পদের তুলনায় দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মোট সম্পদ ৪ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। আর বর্তমানে দায়ের পরিমাণ ৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ভারতে কারাবন্দি আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আর বাংলঅদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সের মোট সম্পদ ৯২৭ দশমিক ২৯ কোটি টাকা হলেও প্রতিষ্ঠানটির দায় ১ হাজার ৮৩৫ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠান থেকে মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নেওয়া টাকার পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সংঘটিত আর্থিক অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে এবং পরিদর্শনের দায়িত্ব সম্পাদনকারী বিভাগে সংশ্লিষ্ট সময়ে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের প্রত্যেকেই যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুপাতে কর্মকালের ব্যাপ্তিভেদে দায়ী।’ পাশাপাশি যথাযথ তদারকি না করায় রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং অডিট ফার্মগুলোকেও ওই প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: আইপিডিসির শেয়ার কারসাজিঃ আবারও জরিমানার মুখে হিরো

প্রতিবেদনে বিএসইসি ও আরজেএসসির দায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স বছরের পর বছর মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা আড়াল এবং কাল্পনিক মুনাফা দেখিয়েছে। কিন্তু আরজেএসসি এবং বিএসইসি কখনো কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়নি। যদি তারা সময় মতো পদক্ষেপ নিতো তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটিতে এ ধরনের অনিয়ম বছরের পর বছর ধরে চলে আসত পারতো না। তাই এ দুটি প্রতিষ্ঠানও দায় এড়াতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন নি।

আরও পড়ুন: পেপার প্রসেসিং ও মনোস্পুল পেপারের হিসাবে নিরীক্ষকের আপত্তি

উল্লেখ্য, আর্থিক খাতের এ দুটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ ২৪৯ কর্মকর্তার দায় রয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই লুটপাটের জন্য প্রধানত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগকে দায়ী করা হয়েছে। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী ৩ জন ডেপুটি গভর্নর, ৬ জন নির্বাহী পরিচালক, ১১ জন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এবং ১৫ জন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এবং বিভিন্ন পর্যায়ের আরও ১২৪ কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের দুজন ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকসহ মোট ৫১ জনকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের দুজন ডেপুটি গভর্নর, ৮ জন নির্বাহী পরিচালক, ৫ জন জিএমসহ মোট ২৯ কর্মকর্তার নাম এসেছে।

ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পি কে হালদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট অস্তিত্ববিহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত জামানত ছাড়াই মোট ৩ হাজার ১২৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিতরণের মাধ্যমে এই টাকা নেওয়া হয়েছে। এসব আর্থিক অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং অপরাধে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর ক্রেডিট কমিটি, এক্সিকিউটিভ কমিটিসহ পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্ট সব সদস্য এবং ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুযায়ী দায়ী।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৩৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৬৮টি হিসাবের ঋণ স্থিতি ২ হাজার ৯৫৫.২৫ কোটি টাকা দীর্ঘদিন অনাদায়িভাবে পড়ে আছে। এ টাকা নামে-বেনামে প্রকৃতপক্ষে প্রশান্ত কুমার হালদার এবং তার সহযেযাগীদের কাছে গিয়েছে বলে বিএফআইইউর অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে।

এছাড়া ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনের মাধ্যমে পি কে হালদার গংয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অস্তিত্ববিহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডে স্থানান্তরিত অর্থের স্থিতি রয়েছে আরও ১৭৪.৩৮ কোটি টাকা। এই মোট ৩ হাজার ১২৯.৬৩ কোটি টাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে। এ আত্মসাতের জন্য সুবিধাভোগীদের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়ী।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আইএলএফএসএলের ৭ হাজার ৮১০ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা দায় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কলমানি হিসাবে ৫৩ দশমিক ১১ কোটি টাকা, ট্রেজারি লাইনে ১৬৭ দশমিক ৩৯ কোটি, মেয়াদি আমানতে ১ হাজার ৩২ দশমিক ২৫ কোটি ও মেয়াদি ঋণে ৮৪২ দশমিক ৫১ কোটি টাকা।

এছাড়া ৩ হাজার ১৬০ জন ব্যক্তি ও ৯৯৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত হিসাবে ১ হাজার ৫৮৯.৮৬ কোটি টাকা। মোট ৩ হাজার ৬৮৫.১২ কোটি টাকা গ্রহণ করে বছরের পর বছর ধরে অপরিশোধিত অবস্থায় আটকে থাকায় মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি সৃষ্টি হয়েছে। এসব আমানতকারীর পাওনা ফেরত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে বিআইএফসি গঠনের পর থেকে ২০১৬ সালের ৯ মার্চ পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদে যারা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা সবাই মেজর (অব.) মান্নানের আত্মীয়স্বজন ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। মেজর (অব.) মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬৭টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫১৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা নিয়েছে। দৈনিক কালবেলার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, পুঁজিবাজারে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ২০০৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৫.৮০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। ২০১৮ সালের পর কোম্পানিটি সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের জন্য কোন ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি। কোম্পানিটির পূঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৩ হাজার ৪৩৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৩৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর ২০২২ শেষে কোম্পানিটির মোট ২২ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৪৬টি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে ৪১.৫৪ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৪.৭০ শতাংশ, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.০১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৩.৭৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

আরও পড়ুন: পিকে হালদারের প্রতারণার ফাঁদে তালিকাভুক্ত ৪ কোম্পানি

বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করছে। ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ১০.৬০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। ২০১৩ সালের পর কোম্পানিটি সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের জন্য কোন ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি। কোম্পানিটির পূঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৭৬৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়া কোম্পানিটির স্বল্পমেয়াদে ১৫০ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদে ৮৯ কোটি ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২২ শেষে কোম্পানিটির মোট ১০ কোটি ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৯৪৪টি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে ৪০.৫৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৪১.৬১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৭.৮৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। 

ঢাকা/বিজনেসজার্নাল/এইচকে

শেয়ার করুন

x
English Version

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসি’র আর্থিক কেলেঙ্কারি: দায় এড়াতে পারে না বিএসইসি

আপডেট: ০৪:৫৩:১২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ অক্টোবর ২০২২

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) থেকে অবৈধভাবে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে মোট ৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। এরমধ্যে শুধু ভারতে কারাবন্দি প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেই ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আর বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান ও তার প্রতিষ্ঠান বিআইএফসি থেকে নিয়ে গেছে ৬০০ কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে এই লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও নিশ্চুপ ছিলেন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকই নয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ, এবং অডিট ফার্মগুলোও এক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব্য পালন করেনি। নজিরবিহীন এই আর্থিক অনিয়মের কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির আলাদা তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ইতিমধ্যে মোট ১২শ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দুটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নজিরবিহীন এই লুটের ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটির মোট সম্পদের তুলনায় দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মোট সম্পদ ৪ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। আর বর্তমানে দায়ের পরিমাণ ৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ভারতে কারাবন্দি আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আর বাংলঅদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সের মোট সম্পদ ৯২৭ দশমিক ২৯ কোটি টাকা হলেও প্রতিষ্ঠানটির দায় ১ হাজার ৮৩৫ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠান থেকে মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নেওয়া টাকার পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সংঘটিত আর্থিক অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে এবং পরিদর্শনের দায়িত্ব সম্পাদনকারী বিভাগে সংশ্লিষ্ট সময়ে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের প্রত্যেকেই যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুপাতে কর্মকালের ব্যাপ্তিভেদে দায়ী।’ পাশাপাশি যথাযথ তদারকি না করায় রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং অডিট ফার্মগুলোকেও ওই প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: আইপিডিসির শেয়ার কারসাজিঃ আবারও জরিমানার মুখে হিরো

প্রতিবেদনে বিএসইসি ও আরজেএসসির দায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স বছরের পর বছর মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা আড়াল এবং কাল্পনিক মুনাফা দেখিয়েছে। কিন্তু আরজেএসসি এবং বিএসইসি কখনো কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়নি। যদি তারা সময় মতো পদক্ষেপ নিতো তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটিতে এ ধরনের অনিয়ম বছরের পর বছর ধরে চলে আসত পারতো না। তাই এ দুটি প্রতিষ্ঠানও দায় এড়াতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন নি।

আরও পড়ুন: পেপার প্রসেসিং ও মনোস্পুল পেপারের হিসাবে নিরীক্ষকের আপত্তি

উল্লেখ্য, আর্থিক খাতের এ দুটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ ২৪৯ কর্মকর্তার দায় রয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই লুটপাটের জন্য প্রধানত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগকে দায়ী করা হয়েছে। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী ৩ জন ডেপুটি গভর্নর, ৬ জন নির্বাহী পরিচালক, ১১ জন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এবং ১৫ জন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এবং বিভিন্ন পর্যায়ের আরও ১২৪ কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের দুজন ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকসহ মোট ৫১ জনকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের দুজন ডেপুটি গভর্নর, ৮ জন নির্বাহী পরিচালক, ৫ জন জিএমসহ মোট ২৯ কর্মকর্তার নাম এসেছে।

ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পি কে হালদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট অস্তিত্ববিহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত জামানত ছাড়াই মোট ৩ হাজার ১২৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিতরণের মাধ্যমে এই টাকা নেওয়া হয়েছে। এসব আর্থিক অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং অপরাধে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর ক্রেডিট কমিটি, এক্সিকিউটিভ কমিটিসহ পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্ট সব সদস্য এবং ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুযায়ী দায়ী।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৩৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৬৮টি হিসাবের ঋণ স্থিতি ২ হাজার ৯৫৫.২৫ কোটি টাকা দীর্ঘদিন অনাদায়িভাবে পড়ে আছে। এ টাকা নামে-বেনামে প্রকৃতপক্ষে প্রশান্ত কুমার হালদার এবং তার সহযেযাগীদের কাছে গিয়েছে বলে বিএফআইইউর অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে।

এছাড়া ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনের মাধ্যমে পি কে হালদার গংয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অস্তিত্ববিহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডে স্থানান্তরিত অর্থের স্থিতি রয়েছে আরও ১৭৪.৩৮ কোটি টাকা। এই মোট ৩ হাজার ১২৯.৬৩ কোটি টাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে। এ আত্মসাতের জন্য সুবিধাভোগীদের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়ী।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আইএলএফএসএলের ৭ হাজার ৮১০ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা দায় সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কলমানি হিসাবে ৫৩ দশমিক ১১ কোটি টাকা, ট্রেজারি লাইনে ১৬৭ দশমিক ৩৯ কোটি, মেয়াদি আমানতে ১ হাজার ৩২ দশমিক ২৫ কোটি ও মেয়াদি ঋণে ৮৪২ দশমিক ৫১ কোটি টাকা।

এছাড়া ৩ হাজার ১৬০ জন ব্যক্তি ও ৯৯৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত হিসাবে ১ হাজার ৫৮৯.৮৬ কোটি টাকা। মোট ৩ হাজার ৬৮৫.১২ কোটি টাকা গ্রহণ করে বছরের পর বছর ধরে অপরিশোধিত অবস্থায় আটকে থাকায় মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি সৃষ্টি হয়েছে। এসব আমানতকারীর পাওনা ফেরত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে বিআইএফসি গঠনের পর থেকে ২০১৬ সালের ৯ মার্চ পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদে যারা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা সবাই মেজর (অব.) মান্নানের আত্মীয়স্বজন ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। মেজর (অব.) মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬৭টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫১৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা নিয়েছে। দৈনিক কালবেলার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, পুঁজিবাজারে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ২০০৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ৫.৮০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। ২০১৮ সালের পর কোম্পানিটি সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের জন্য কোন ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি। কোম্পানিটির পূঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৩ হাজার ৪৩৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৩৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর ২০২২ শেষে কোম্পানিটির মোট ২২ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৪৬টি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে ৪১.৫৪ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৪.৭০ শতাংশ, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.০১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৩.৭৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

আরও পড়ুন: পিকে হালদারের প্রতারণার ফাঁদে তালিকাভুক্ত ৪ কোম্পানি

বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করছে। ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ১০.৬০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। ২০১৩ সালের পর কোম্পানিটি সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের জন্য কোন ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি। কোম্পানিটির পূঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৭৬৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়া কোম্পানিটির স্বল্পমেয়াদে ১৫০ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদে ৮৯ কোটি ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২২ শেষে কোম্পানিটির মোট ১০ কোটি ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৯৪৪টি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে ৪০.৫৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৪১.৬১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৭.৮৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। 

ঢাকা/বিজনেসজার্নাল/এইচকে