০৭:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

কিন্ডারগার্টেনে দুর্দিন, হতাশ প্রতিষ্ঠান মালিকরা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:০২:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২০
  • / ৪১৫৫ বার দেখা হয়েছে

মো. নিজাম উদ্দিন ২০০৩ সালে রাজধানীর আদাবরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আনজুমান রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল’। অল্প দিনেই প্রতিষ্ঠানটি ওই এলাকায় ভালো সাড়া ফেলে। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী বাড়তে থাকে। এক সময় নিজাম উদ্দিন গাবতলী এলাকায় প্রতিষ্ঠানটিরই আরেকটি শাখা খোলেন। দুই শাখা মিলে ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। চলতি বছর করোনার কারণে ১৭ মার্চ থেকে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে বন্ধ হয় নিজাম উদ্দিনের স্কুলও। এখনও বন্ধই রয়েছে। তবে অন্যান্য বন্ধের চেয়ে এই বন্ধের পার্থক্য হলো, টিউশন ফি আদায় না থাকায় চরম আর্থিক সংকটে পড়েন তিনি। বাড়িভাড়া দিতে না পারায় বিদ্যালয়ের গাবতলী শাখা বন্ধ করে দিয়েছেন নিজাম উদ্দিন। নিজের বাসা ভাড়া দিতে না পেরে তিন মাস আগে আদাবরে নিজের স্কুলেই পরিবার-পরিজন নিয়ে উঠেছেন। এখন স্কুল ভবনের ভাড়াও দিতে না পেরে বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে ফিরছেন।
সমকালকে নিজাম উদ্দিন বলেন, ১৬ মার্চ সরকারি ছুটির নোটিশ পেয়ে পরদিন ১৭ মার্চই স্কুল বন্ধ করে দিই। আকস্মিক এক দিনের নোটিশে বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের কাছে বকেয়া থাকা টিউশন ফিও আদায় করতে পারিনি। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। তিনি জানান, বড় স্বপ্ন নিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন আর কোনোভাবেই চালাতে পারছেন না।

নিজাম উদ্দিনের প্রতিষ্ঠানের মতোই আরেকটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর দক্ষিণখান থানার দক্ষিণপাড়া (নদ্দাপাড়া) এস.এফ মডেল স্কুল। চার শতাধিক শিক্ষার্থীর এ প্রতিষ্ঠানটি চালাতে না পেরে বন্ধ করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল ইসলাম। তবে এ নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো কথা বলতেও রাজি নন রাকিবুল। সাভারের বাইপাইলে অবস্থিত সৃষ্টি সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজও বন্ধ হয় হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা শামীম ইকবাল দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন।
বছিলার নবীনগর হাউজিং এলাকার ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলের মালিক তকবির হোসেন স্কুল বিক্রির জন্য দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে এরই মধ্যে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। তবে স্কুল বিক্রির কোনো গতি করে উঠতে পারেননি।
তার মতোই স্কুল বন্ধ করে দিয়ে গ্রামে চলে গেছেন মিরপুর পীরেরবাগের আলোর দিশারী প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা দীপ আহমেদ ঝলক। সমকালকে জানালেন, স্কুল আর চালাবেন না। স্কুল চালাতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ দেনার ভার ঘাড়ে পড়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় পরিচিতজনরাও এখন আর কেউ ধারও দিতে চাইছেন না।
গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকার ইউ. এন. এ মডেল স্কুলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আবু সাঈদ কাউকে কিছু না জানিয়ে অনেকটাই চুপিসারে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছেন।

দায়-দেনায় জর্জরিত হয়ে এবং বাড়িভাড়া দিতে না পেরে রাজধানীর মাটিকাটা এলাকার আইডিয়াল পাবলিক স্কুল বন্ধ হয়ে যায় গত আগস্টে। শিক্ষার্থীদের একাংশের চাপে স্কুল কর্তৃপক্ষ চলতি মাসে আগের ভবনের পাশেই ‘সাউথ ভিলা’ নামে আরেকটি ভবনের একটি মাত্র ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে স্বল্প পরিসরে আবার স্কুলটি চালু করেছেন। এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নার্গিস আকতার সমকালকে বলেন, তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল তার। মার্চ মাস থেকে একটি টাকাও বিদ্যালয়ের আয় হয়নি। অথচ বাড়িভাড়া ও স্টাফদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছিল। তাই আগস্টে বন্ধ করে দেন। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বিক্রি করে দিতে চেষ্টা করেও ক্রেতা পাননি। স্কুলের সব মালপত্র একটি বাড়ির ছাদে ও গ্যারেজে নিয়ে রাখেন। পরে গ্যারেজ থেকে বেশ কয়েকটি বেঞ্চ চুরি হয়ে যায়। তিন মাস বন্ধ থাকার পর অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চাপে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ফের বিদ্যালয় খুলেছেন। নার্গিস আকতার বলেন, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট কীভাবে লিখতে হবে সে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেওয়ার জন্য বিদ্যালয় আপাতত খুলেছি। জানি না কতদিন চালাতে পারব।

এসব বিদ্যালয়ের মতোই করোনাকালে মহাদুর্দিন নেমে এসেছে সারাদেশের সব কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। গত ১৭ মার্চ থেকে অনেকটা আকস্মিতভাবেই বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বকেয়া টিউশন ফি আদায় হয়নি। আয় না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়াও সম্ভব হয়নি। স্বল্প বেতনের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেশিরভাগই বেতন-ভাতা না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মধ্যে গত সাত মাসে অন্তত দেড় হাজার স্কুল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ভাড়া বাড়িতে থাকা এসব স্কুল গুটিয়ে নিয়ে কর্তৃপক্ষ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। নেমে গেছে স্কুলের সাইনবোর্ড। কোনো রকম আগাম বার্তা বা নোটিশ না দিয়ে স্কুল উধাও হয়ে যাওয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও পড়েছেন বিপাকে। আসছে জানুয়ারিতে অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক অভিভাবক সন্তানের টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) আনতে গিয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্পূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব বিদ্যাপীঠের মালিকদের কেউই লোকসান দিয়ে বিদ্যালয় চালাতে আর চাইছেন না অথবা পারছেন না। সে কারণেই মূলত দেড় হাজার বিদ্যালয় এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সব চরম আর্থিক সংকটে ধুঁকছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউই কয়েক মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। লাখ লাখ টাকা বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে। উদ্যোক্তারা এখন সরকারি সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন, কবে স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হবে সেদিকে। ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে অন্তত সোয়া কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী সমকালকে বলেন, আক্ষরিক অর্থেই কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীরা না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্ডারগার্টেনগুলোর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট রয়েছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ ও তাদের পরিবার। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার প্রসারেই শুধু ভূমিকা রাখছে তা নয়, দেশের বেকারত্ব নিরসনেও এক বিশাল অবদান রাখছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফির ওপর নির্ভরশীল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯৯ শতাংশই ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দেওয়া মাসিক টিউশন ফির ৪০ শতাংশ বাড়িভাড়া, ৪০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, বাকি ২০ শতাংশ গ্যাস বিল, বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল, পানির বিলসহ অন্যান্য খরচ নির্বাহে চলে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফির অর্থে খরচ নির্বাহ না হওয়ায় ভর্তুকি দিতে হয়। এ অবস্থায় স্কুল বন্ধ থাকায় মার্চ মাস থেকে কোনো টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় সব ধরনের বিলসহ বাড়িভাড়া, বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ির মালিক বাড়িভাড়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও গরিব কর্মচারীরা অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষক সমাজ বিভিন্ন সময় সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছে। শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদার কারণে কারও কাছে হাত পাততে পারেন না। লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণও গ্রহণ করতে পারেন না। বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে জীবন ধারণ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় তাদের দাবি, স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হোক।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম সমকালকে বলেন, ‘যেসব কিন্ডারগার্টেন ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বা যারা গ্রামে চলে গেছেন, তারা তাদের সন্তানদের কাছাকাছি সরকারি স্কুলে টিসি ছাড়া ভর্তি করাতে পারবেন। এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে সার্কুলার জারি করেছে।’

কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, ইতোমধ্যে দেশের অন্তত দেড় হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুল না খুললে আরও প্রায় ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাবে। তবে অনেকেই স্কুল বিক্রির নোটিশ দিলেও সেখানে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্ডারগার্টেনের ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেশিরভাগই পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ কেউ ছোটখাটো নানা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন।
কিন্ডারগার্টেন ও সমমান স্কুল রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব জি এম কবির রানা বলেন, ‘আর্থিক অনটনে ইতোমধ্যে ১৪ জন শিক্ষক হৃদরোগ, আত্মহত্যাসহ নানা কারণে মারা গেছেন। দেড় হাজার স্কুল ভাড়া দিতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা পেশা পরিবর্তন করেছেন। এ অবস্থায় আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতি মাসেই স্কুল খুলে দেওয়া, শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং নিজ নিজ স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’

শেয়ার করুন

x
English Version

কিন্ডারগার্টেনে দুর্দিন, হতাশ প্রতিষ্ঠান মালিকরা

আপডেট: ১১:০২:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২০

মো. নিজাম উদ্দিন ২০০৩ সালে রাজধানীর আদাবরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আনজুমান রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল’। অল্প দিনেই প্রতিষ্ঠানটি ওই এলাকায় ভালো সাড়া ফেলে। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী বাড়তে থাকে। এক সময় নিজাম উদ্দিন গাবতলী এলাকায় প্রতিষ্ঠানটিরই আরেকটি শাখা খোলেন। দুই শাখা মিলে ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। চলতি বছর করোনার কারণে ১৭ মার্চ থেকে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে বন্ধ হয় নিজাম উদ্দিনের স্কুলও। এখনও বন্ধই রয়েছে। তবে অন্যান্য বন্ধের চেয়ে এই বন্ধের পার্থক্য হলো, টিউশন ফি আদায় না থাকায় চরম আর্থিক সংকটে পড়েন তিনি। বাড়িভাড়া দিতে না পারায় বিদ্যালয়ের গাবতলী শাখা বন্ধ করে দিয়েছেন নিজাম উদ্দিন। নিজের বাসা ভাড়া দিতে না পেরে তিন মাস আগে আদাবরে নিজের স্কুলেই পরিবার-পরিজন নিয়ে উঠেছেন। এখন স্কুল ভবনের ভাড়াও দিতে না পেরে বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে ফিরছেন।
সমকালকে নিজাম উদ্দিন বলেন, ১৬ মার্চ সরকারি ছুটির নোটিশ পেয়ে পরদিন ১৭ মার্চই স্কুল বন্ধ করে দিই। আকস্মিক এক দিনের নোটিশে বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের কাছে বকেয়া থাকা টিউশন ফিও আদায় করতে পারিনি। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। তিনি জানান, বড় স্বপ্ন নিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন আর কোনোভাবেই চালাতে পারছেন না।

নিজাম উদ্দিনের প্রতিষ্ঠানের মতোই আরেকটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর দক্ষিণখান থানার দক্ষিণপাড়া (নদ্দাপাড়া) এস.এফ মডেল স্কুল। চার শতাধিক শিক্ষার্থীর এ প্রতিষ্ঠানটি চালাতে না পেরে বন্ধ করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল ইসলাম। তবে এ নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো কথা বলতেও রাজি নন রাকিবুল। সাভারের বাইপাইলে অবস্থিত সৃষ্টি সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজও বন্ধ হয় হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা শামীম ইকবাল দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন।
বছিলার নবীনগর হাউজিং এলাকার ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলের মালিক তকবির হোসেন স্কুল বিক্রির জন্য দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে এরই মধ্যে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। তবে স্কুল বিক্রির কোনো গতি করে উঠতে পারেননি।
তার মতোই স্কুল বন্ধ করে দিয়ে গ্রামে চলে গেছেন মিরপুর পীরেরবাগের আলোর দিশারী প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা দীপ আহমেদ ঝলক। সমকালকে জানালেন, স্কুল আর চালাবেন না। স্কুল চালাতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ দেনার ভার ঘাড়ে পড়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় পরিচিতজনরাও এখন আর কেউ ধারও দিতে চাইছেন না।
গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকার ইউ. এন. এ মডেল স্কুলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আবু সাঈদ কাউকে কিছু না জানিয়ে অনেকটাই চুপিসারে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছেন।

দায়-দেনায় জর্জরিত হয়ে এবং বাড়িভাড়া দিতে না পেরে রাজধানীর মাটিকাটা এলাকার আইডিয়াল পাবলিক স্কুল বন্ধ হয়ে যায় গত আগস্টে। শিক্ষার্থীদের একাংশের চাপে স্কুল কর্তৃপক্ষ চলতি মাসে আগের ভবনের পাশেই ‘সাউথ ভিলা’ নামে আরেকটি ভবনের একটি মাত্র ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে স্বল্প পরিসরে আবার স্কুলটি চালু করেছেন। এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নার্গিস আকতার সমকালকে বলেন, তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল তার। মার্চ মাস থেকে একটি টাকাও বিদ্যালয়ের আয় হয়নি। অথচ বাড়িভাড়া ও স্টাফদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছিল। তাই আগস্টে বন্ধ করে দেন। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বিক্রি করে দিতে চেষ্টা করেও ক্রেতা পাননি। স্কুলের সব মালপত্র একটি বাড়ির ছাদে ও গ্যারেজে নিয়ে রাখেন। পরে গ্যারেজ থেকে বেশ কয়েকটি বেঞ্চ চুরি হয়ে যায়। তিন মাস বন্ধ থাকার পর অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চাপে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ফের বিদ্যালয় খুলেছেন। নার্গিস আকতার বলেন, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট কীভাবে লিখতে হবে সে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেওয়ার জন্য বিদ্যালয় আপাতত খুলেছি। জানি না কতদিন চালাতে পারব।

এসব বিদ্যালয়ের মতোই করোনাকালে মহাদুর্দিন নেমে এসেছে সারাদেশের সব কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। গত ১৭ মার্চ থেকে অনেকটা আকস্মিতভাবেই বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বকেয়া টিউশন ফি আদায় হয়নি। আয় না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়াও সম্ভব হয়নি। স্বল্প বেতনের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেশিরভাগই বেতন-ভাতা না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মধ্যে গত সাত মাসে অন্তত দেড় হাজার স্কুল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ভাড়া বাড়িতে থাকা এসব স্কুল গুটিয়ে নিয়ে কর্তৃপক্ষ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। নেমে গেছে স্কুলের সাইনবোর্ড। কোনো রকম আগাম বার্তা বা নোটিশ না দিয়ে স্কুল উধাও হয়ে যাওয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও পড়েছেন বিপাকে। আসছে জানুয়ারিতে অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক অভিভাবক সন্তানের টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) আনতে গিয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্পূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব বিদ্যাপীঠের মালিকদের কেউই লোকসান দিয়ে বিদ্যালয় চালাতে আর চাইছেন না অথবা পারছেন না। সে কারণেই মূলত দেড় হাজার বিদ্যালয় এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সব চরম আর্থিক সংকটে ধুঁকছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউই কয়েক মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। লাখ লাখ টাকা বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে। উদ্যোক্তারা এখন সরকারি সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন, কবে স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হবে সেদিকে। ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে অন্তত সোয়া কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী সমকালকে বলেন, আক্ষরিক অর্থেই কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীরা না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্ডারগার্টেনগুলোর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট রয়েছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ ও তাদের পরিবার। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার প্রসারেই শুধু ভূমিকা রাখছে তা নয়, দেশের বেকারত্ব নিরসনেও এক বিশাল অবদান রাখছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফির ওপর নির্ভরশীল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯৯ শতাংশই ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দেওয়া মাসিক টিউশন ফির ৪০ শতাংশ বাড়িভাড়া, ৪০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, বাকি ২০ শতাংশ গ্যাস বিল, বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল, পানির বিলসহ অন্যান্য খরচ নির্বাহে চলে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফির অর্থে খরচ নির্বাহ না হওয়ায় ভর্তুকি দিতে হয়। এ অবস্থায় স্কুল বন্ধ থাকায় মার্চ মাস থেকে কোনো টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় সব ধরনের বিলসহ বাড়িভাড়া, বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ির মালিক বাড়িভাড়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও গরিব কর্মচারীরা অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষক সমাজ বিভিন্ন সময় সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছে। শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদার কারণে কারও কাছে হাত পাততে পারেন না। লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণও গ্রহণ করতে পারেন না। বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে জীবন ধারণ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় তাদের দাবি, স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হোক।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম সমকালকে বলেন, ‘যেসব কিন্ডারগার্টেন ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বা যারা গ্রামে চলে গেছেন, তারা তাদের সন্তানদের কাছাকাছি সরকারি স্কুলে টিসি ছাড়া ভর্তি করাতে পারবেন। এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে সার্কুলার জারি করেছে।’

কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, ইতোমধ্যে দেশের অন্তত দেড় হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুল না খুললে আরও প্রায় ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাবে। তবে অনেকেই স্কুল বিক্রির নোটিশ দিলেও সেখানে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্ডারগার্টেনের ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেশিরভাগই পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ কেউ ছোটখাটো নানা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন।
কিন্ডারগার্টেন ও সমমান স্কুল রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব জি এম কবির রানা বলেন, ‘আর্থিক অনটনে ইতোমধ্যে ১৪ জন শিক্ষক হৃদরোগ, আত্মহত্যাসহ নানা কারণে মারা গেছেন। দেড় হাজার স্কুল ভাড়া দিতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা পেশা পরিবর্তন করেছেন। এ অবস্থায় আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতি মাসেই স্কুল খুলে দেওয়া, শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং নিজ নিজ স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’