১১:১২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

জেমিনী’র চমকপ্রদ ডিভিডেন্ডে বিনিয়োগকারীদের লোকসান ২৩ কোটি টাকা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৬:২৮:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর ২০২২
  • / ৪৬৯৬ বার দেখা হয়েছে

ফাইল ফটো

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি জেমিনী সী ফুডসে ডিভিডেন্ড চমকে একদিনের ব্যবধানে বিনিয়োগকারীদের ২৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা উধাও হয়ে গিয়েছে। অর্থ্যাৎ আজকের সর্বশেষ বাজার দর হিসেবে জেমিনী সী ফুডের বিনিয়োগকারীদের মূলধন কমেছে ২৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কারণ গতকাল কোম্পানিটির ডিভিডেন্ড ঘোষণার পর আজ দিন শেষে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৫৯৩.৪০ টাকা থেকে কমে সর্বশেষ ৫০৯.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। সে হিসেবে কোম্পানিটির শেয়ার দর একদিনের ব্যবধানে কমেছে ৮৪.২০ টাকা।

জানা গেছে, জেমিনি সি ফুড ৩০ জুন ২০২২ সমাপ্ত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৪০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ ক্যাশ এবং ৩০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড। গত চার বছরের মধ্যে এটি কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ডিভিডেন্ড।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এর আগে ২০১৮ সালে কোম্পানিটি ১৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড, ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড, ২০২০ সালে ‘নো ডিভিডেন্ড’ এবং গত বছর ২০২১ সালে ৫ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।

এছাড়া আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১২ টাকা ৪৯ পয়সা, যা আগের বছর ছিল শেয়ার প্রতি ৭২ পয়সা। এছাড়া শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩০ টাকা ০১ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। অথচ ৪ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূলধনের এ কোম্পানিটি পুঞ্জীভূত লোকসানে রয়েছে। আর এ কারণে অস্বাভাবিক আয়ের পাশাপাশি বিশাল অঙ্কের স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষনার বিষয়টি অসঙ্গতিপূর্ণ এবং সন্দেহজনক বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, কোম্পানিটির মোট ৪৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩১২টি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে ৩৩.৬৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে৬.৪২ শতাংশ, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.৩৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫৯.৬০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

সে হিসেবে বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা মোট শেয়ারের ৫৯.৬০ শতাংশ বা ২৭ লাখ ৯৯ হাজার ১টি শেয়ারে প্রতিটি ৮৪.২০ টাকা করে কমে ২৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৮৮৪ টাকা কমেছে। অনুরুপভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ৬.৪২ শতাংশ (৩ লাখ ১ হাজার ৫০৩টি) শেয়ারে কমেছে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৭১ টাকা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ০.৩৩ শতাংশ বা ১৫ হাজার ৪৯৭টি শেয়ারে কমেছে ১৩ লাখ ৪ হাজার ৯১৭ টাকা।

অর্থ্যাৎ আজকে বাজার দর হিসেবে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বাদে প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশী ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারে মোট ২৬ কোটি ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭২ টাকা কমেছে।

আরও পড়ুন: পুঞ্জীভূত লোকসানি কোম্পানির ৪০ শতাংশ ডিভিডেন্ড: খতিয়ে দেখার দাবি

শুধু তাই নয়, সাধারনত একটি কোম্পানির ডিভিডেন্ড সব ধরনের শেয়ারহোল্ডার নেয়। তবে সক্ষমতার অভাবে এবং ক্যাটাগরি ধরে রাখার জন্য বা উপরে উঠার জন্য মাঝেমধ্যে কিছু কোম্পানির উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ক্যাশ ডিভিডেন্ড নিতে দেখা যায় না। কিন্তু জেমিনি সী ফুডের বড় মুনাফা অর্জন সত্ত্বেও উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা ক্যাশ ডিভিডেন্ড নেবে না। যে কারনে জেমিনির প্রকৃত মুনাফা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেয়ারটি নিয়ে কারসাজির উদ্দেশ্যে এমনটি করা হয়ে থাকতে পারে। যে কোম্পানিটির ডিভিডেন্ড ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এরইমধ্যে অস্বাভাবিক দর বেড়েছে।

মাঝেমধ্যে কিছু কোম্পানির কর্তৃপক্ষ লোকসান সত্ত্বেও মুনাফা দেখায় এবং ডিভিডেন্ড ঘোষনা করে থাকে। বিশেষ করে ছোট মূলধনী কোম্পানিগুলো এমনটি করে থাকে। এক্ষেত্রে তারা ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদান করে শেয়ার কারসাজি থেকে অর্জিত মুনাফা থেকে। ওইসব কোম্পানিতে কারসাজিতে যে পরিমাণ মুনাফা করে, তার থেকে ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদানে ব্যয় অনেক কম হয়ে থাকে। যে কারনে মুনাফা না করেও কিছু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ গেম্বলারদের সাথে হাত মিলিয়ে এমন ডিভিডেন্ড দিয়ে থাকে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আড়াই বছর আগে শেয়ারবাজারের ধারাবাহিক পতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ২০২০ সালের ২৫ মার্চ দেশের শেয়ারবাজারে প্রথম ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিল। তখন জেমিনি সী ফুডের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয় ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সায়। ফ্লোর প্রাইসে ২০২১ সালের ৭ জুন পর্যন্ত এক বছর তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ার ঠায় দাঁড়িয়েছিল।

২০২১ সালের ৮ জুন থেকে ফ্লোর প্রাইস থেকে হঠাৎ কোম্পানিটির শেয়ার জেগে উঠে। এরপর টানা উত্থান। ১১ মাসের মাথায় চলতি বছরের ৪ এপ্রিল শেয়ারটির দাম ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৫৪০ টাকায় উঠে যায়। তারপর কিছুটা সংশোধন হয়। দেড় মাসের মাথায় ২৬ মে শেয়ারটির দাম ২৯৬ টাকার নিচে নেমে আসে। তারপর প্রায় একই জায়গায় দুই মাসের পূর্ণ বিরতি। এরপর ফের উত্থান। গত কয়েকদিনে শেয়ারটি যেন নতুন জোয়ার পায়। টানা বাড়তে থাকে। এরমধ্যে একাধিক কার্যদিবস সর্বোচ্চ দরে ক্রেতাশুন্যও থাকে। বুধবার (১৯ অক্টোবর) শেয়ারটি দাম ৫৯৩ টাকা ৪০ পয়সায় ক্রেতাশুন্য থাকে। যা কোম্পানিটির রেকর্ড সর্বোচ্চ দর।

আজ স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কোম্পানিটির লভ্যাংশ ঘোষণার খবর আসে। লভ্যাংশের চমকে দিনের শুরুতে শেয়ারটির দরে বড় লাফ দেখা যায়। তারপর কারসাজিকারিদের পরিকল্পিত সেল। গত দুই বছরের মধ্যে ডিএসইতে আজ কোম্পানিটির সর্বোচ্চ রেকর্ড লেনদেন হয়েছে। গত দুই বছরে কোম্পানিটির শেয়ার যেখানে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজারের নিচে, আজ সেখানে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ২৮ হাজার শেয়ার। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। এটি কোম্পানিটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ টাকার লেনদেন।

এছাড়া, আজ কোম্পানিটির শেয়ার দরে যে উত্থান-পতন হয়েছে, তাও কোম্পানিটির ইতিহাসে সেরা। এর আগে কোম্পানিটির শেয়ার দরে এমন আকাশ-পাতাল উত্থান-পতন দেখা যায়নি। আজ কোম্পানিটির শেয়ার প্রথমভাগে ৫৩৮ টাকা ৯০ পয়সায় স্পর্শ করে লেনদেন হয়। পরে সেল প্রেসারে ৪৯৫ টাকা ১০ পয়সায় নেমে যায়। সার্কিট ব্রেকার না থাকায় আজ কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেনে ১৪৩ টাকা পার্থক্য দেখা যায়। যা অবশ্যই অস্বাভাবিক। দিনশেষে শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইস হয়েছে ৫০৯ টাকা ২০ পয়সায়।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটির শেয়ারের দরের সঙ্গে চমকপ্রদ ডিভিডেন্ডের পরিকল্পিত যোগসাজস রয়েছে। যে কারণে ডিভিডেন্ডের চমক থাকার পরও আকাশে উঠা শেয়ারটি ধপাস করে মাটিতে পড়েছে। যেসব বিনিয়োগকারী লোভে পড়ে শেয়ারটি চড়া দরে কিনেছেন, তারা ভালোভাবেই ধরা খেয়েছেন- এটা এখন নিশ্চিত বলা যায়। কোম্পানিটির শেয়ার কোনো বিবেচনায়ই এমন আকাশচুম্বী দর হতে পারে না।

তাদের মতে, স্বল্পমূলধনী এ কোম্পানিটি এমনিতেই পূঞ্জীভুত লোকসানে রয়েছে। এছাড়া সর্বশেষ ৯ মাসের হিসেবেও যার ইপিএস ছিল ৫ টাকা ১৬ পয়সা, হঠাৎ করে কি এমন হলো যে শেষের তিন মাসে কোম্পানিটির ইপিএস ৭ টাকারও বেশি বেড়ে গেল! এছাড়া ৪০ শতাংশ ডিভিডেন্ডের মধ্যে ৩০ শতাংশই স্টক ডিভিডেন্ড। কাজেই কোম্পানিটি স্টক ডিভিডেন্ডের নামে বিনিয়োগকারীদের কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখার দাবি জানান তারা।

তারা আরও বলছেন, দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানিই সমাপ্ত বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য স্টক ডিভিডেন্ড প্রদান করে। এতে শেয়ার সংখ্যা বাড়লেও থিওরিটিক্যাল অ্যাডজাস্টমেন্টের কারণে শেয়ার দর কমে যায়। পরিণতিতে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের মুনাফার হাড়ি বোঝাই হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। কারণ হিসেবে তারা বলেন, আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা স্বল্প সময়ে মুনাফা লাভের উদ্দেশে বিনিয়োগ করে থাকেন।

ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, কোম্পানির চলতি ২০২১-২২ হিসাব বছরের আয়ে এক ভুতুড়ে হিসাব দেখা যায়। কোম্পানি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ার প্রতি ৫ টাকার বেশি আয় করলেও তৃতীয় প্রান্তিকে আয় করেছে মাত্র ৪ পয়সা। এদিকে ৯ মাসের ব্যবধানে এনএভি বেড়েছে ৫১৯ শতাংশের বেশি। কোম্পানিটির আয়ে এবং আর্থিক প্রতিবেদন এমন গরমিলে হিসাবকে ‘ভুতুড়ে’ হিসাব বলছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, ২০২০-২১ হিসাব বছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) ছিল ৭২ পয়সা এবং শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ৯৩ পয়সা। কিন্তু ২০২১-২২ হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে এসে কোম্পানটি ইপিএস দেখায় ৫ টাকা ১২ পয়সা, এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে ১ টাকা ৫৬ পয়সা ও পরের তিন মাসে ৩ টাকা ৫১ পয়সা ছিল। কিন্তু পরের তিন মাসে এসে কোম্পানিটি ইপিএস দেখায় ৪ পয়সা। তবে ৯ মাসের ব্যবধানে আবার এনএভি ৫১৯ শতাংশের বেশি হিসাবে দেখানো হয়েছে ৫ টাকা ৭৬ পয়সা।

সর্বশেষ আজ কোম্পানিটির বোর্ড সভায় কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১২ টাকা ৪৯ পয়সা এবং শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) ৩০ টাকা ০১ পয়সা ঘোষণা করা হয়েছে। যা পুরোটাই সন্দেহজনক। এমন শেয়ার কারসাজির যোগসাজশ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন: জেমিনি সি ফুডের ডিভিডেন্ড ঘোষণা

অপরদিকে কোম্পানিটির বিগত আর্থিক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৯ টাকা ৮৩ পয়সা। এর আগের ২০১৮ ও ২০১৯ হিসাব বছরে যথাক্রমে ইপিএস হয়েছে মাত্র ৭০ ও ৩৭ পয়সা। আর ২০২০ সালে এনএভি ছিল মাত্র ২১ পয়সা।

প্রসঙ্গত, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে কোম্পানিটির কাছে এ বছরের ৬ সেপ্টেম্বর শেয়ার দর ও লেনদেন বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চায়। তখন কোম্পানি অস্বাভাবিক শেয়ার দর ও লেনদেন বৃদ্ধির পেছনে অপ্রকাশিত কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে ডিএসইকে জানায়।

ঢাকা/এইচকে

শেয়ার করুন

x
English Version

জেমিনী’র চমকপ্রদ ডিভিডেন্ডে বিনিয়োগকারীদের লোকসান ২৩ কোটি টাকা

আপডেট: ০৬:২৮:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর ২০২২

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি জেমিনী সী ফুডসে ডিভিডেন্ড চমকে একদিনের ব্যবধানে বিনিয়োগকারীদের ২৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা উধাও হয়ে গিয়েছে। অর্থ্যাৎ আজকের সর্বশেষ বাজার দর হিসেবে জেমিনী সী ফুডের বিনিয়োগকারীদের মূলধন কমেছে ২৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কারণ গতকাল কোম্পানিটির ডিভিডেন্ড ঘোষণার পর আজ দিন শেষে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৫৯৩.৪০ টাকা থেকে কমে সর্বশেষ ৫০৯.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। সে হিসেবে কোম্পানিটির শেয়ার দর একদিনের ব্যবধানে কমেছে ৮৪.২০ টাকা।

জানা গেছে, জেমিনি সি ফুড ৩০ জুন ২০২২ সমাপ্ত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৪০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ ক্যাশ এবং ৩০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড। গত চার বছরের মধ্যে এটি কোম্পানিটির সর্বোচ্চ ডিভিডেন্ড।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এর আগে ২০১৮ সালে কোম্পানিটি ১৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড, ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড, ২০২০ সালে ‘নো ডিভিডেন্ড’ এবং গত বছর ২০২১ সালে ৫ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।

এছাড়া আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১২ টাকা ৪৯ পয়সা, যা আগের বছর ছিল শেয়ার প্রতি ৭২ পয়সা। এছাড়া শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩০ টাকা ০১ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। অথচ ৪ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূলধনের এ কোম্পানিটি পুঞ্জীভূত লোকসানে রয়েছে। আর এ কারণে অস্বাভাবিক আয়ের পাশাপাশি বিশাল অঙ্কের স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষনার বিষয়টি অসঙ্গতিপূর্ণ এবং সন্দেহজনক বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, কোম্পানিটির মোট ৪৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩১২টি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে ৩৩.৬৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে৬.৪২ শতাংশ, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.৩৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫৯.৬০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

সে হিসেবে বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা মোট শেয়ারের ৫৯.৬০ শতাংশ বা ২৭ লাখ ৯৯ হাজার ১টি শেয়ারে প্রতিটি ৮৪.২০ টাকা করে কমে ২৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৮৮৪ টাকা কমেছে। অনুরুপভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ৬.৪২ শতাংশ (৩ লাখ ১ হাজার ৫০৩টি) শেয়ারে কমেছে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৭১ টাকা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ০.৩৩ শতাংশ বা ১৫ হাজার ৪৯৭টি শেয়ারে কমেছে ১৩ লাখ ৪ হাজার ৯১৭ টাকা।

অর্থ্যাৎ আজকে বাজার দর হিসেবে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বাদে প্রাতিষ্ঠানিক, বিদেশী ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারে মোট ২৬ কোটি ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭২ টাকা কমেছে।

আরও পড়ুন: পুঞ্জীভূত লোকসানি কোম্পানির ৪০ শতাংশ ডিভিডেন্ড: খতিয়ে দেখার দাবি

শুধু তাই নয়, সাধারনত একটি কোম্পানির ডিভিডেন্ড সব ধরনের শেয়ারহোল্ডার নেয়। তবে সক্ষমতার অভাবে এবং ক্যাটাগরি ধরে রাখার জন্য বা উপরে উঠার জন্য মাঝেমধ্যে কিছু কোম্পানির উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ক্যাশ ডিভিডেন্ড নিতে দেখা যায় না। কিন্তু জেমিনি সী ফুডের বড় মুনাফা অর্জন সত্ত্বেও উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা ক্যাশ ডিভিডেন্ড নেবে না। যে কারনে জেমিনির প্রকৃত মুনাফা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেয়ারটি নিয়ে কারসাজির উদ্দেশ্যে এমনটি করা হয়ে থাকতে পারে। যে কোম্পানিটির ডিভিডেন্ড ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এরইমধ্যে অস্বাভাবিক দর বেড়েছে।

মাঝেমধ্যে কিছু কোম্পানির কর্তৃপক্ষ লোকসান সত্ত্বেও মুনাফা দেখায় এবং ডিভিডেন্ড ঘোষনা করে থাকে। বিশেষ করে ছোট মূলধনী কোম্পানিগুলো এমনটি করে থাকে। এক্ষেত্রে তারা ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদান করে শেয়ার কারসাজি থেকে অর্জিত মুনাফা থেকে। ওইসব কোম্পানিতে কারসাজিতে যে পরিমাণ মুনাফা করে, তার থেকে ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদানে ব্যয় অনেক কম হয়ে থাকে। যে কারনে মুনাফা না করেও কিছু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ গেম্বলারদের সাথে হাত মিলিয়ে এমন ডিভিডেন্ড দিয়ে থাকে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আড়াই বছর আগে শেয়ারবাজারের ধারাবাহিক পতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ২০২০ সালের ২৫ মার্চ দেশের শেয়ারবাজারে প্রথম ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিল। তখন জেমিনি সী ফুডের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয় ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সায়। ফ্লোর প্রাইসে ২০২১ সালের ৭ জুন পর্যন্ত এক বছর তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ার ঠায় দাঁড়িয়েছিল।

২০২১ সালের ৮ জুন থেকে ফ্লোর প্রাইস থেকে হঠাৎ কোম্পানিটির শেয়ার জেগে উঠে। এরপর টানা উত্থান। ১১ মাসের মাথায় চলতি বছরের ৪ এপ্রিল শেয়ারটির দাম ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৫৪০ টাকায় উঠে যায়। তারপর কিছুটা সংশোধন হয়। দেড় মাসের মাথায় ২৬ মে শেয়ারটির দাম ২৯৬ টাকার নিচে নেমে আসে। তারপর প্রায় একই জায়গায় দুই মাসের পূর্ণ বিরতি। এরপর ফের উত্থান। গত কয়েকদিনে শেয়ারটি যেন নতুন জোয়ার পায়। টানা বাড়তে থাকে। এরমধ্যে একাধিক কার্যদিবস সর্বোচ্চ দরে ক্রেতাশুন্যও থাকে। বুধবার (১৯ অক্টোবর) শেয়ারটি দাম ৫৯৩ টাকা ৪০ পয়সায় ক্রেতাশুন্য থাকে। যা কোম্পানিটির রেকর্ড সর্বোচ্চ দর।

আজ স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কোম্পানিটির লভ্যাংশ ঘোষণার খবর আসে। লভ্যাংশের চমকে দিনের শুরুতে শেয়ারটির দরে বড় লাফ দেখা যায়। তারপর কারসাজিকারিদের পরিকল্পিত সেল। গত দুই বছরের মধ্যে ডিএসইতে আজ কোম্পানিটির সর্বোচ্চ রেকর্ড লেনদেন হয়েছে। গত দুই বছরে কোম্পানিটির শেয়ার যেখানে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজারের নিচে, আজ সেখানে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ২৮ হাজার শেয়ার। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। এটি কোম্পানিটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ টাকার লেনদেন।

এছাড়া, আজ কোম্পানিটির শেয়ার দরে যে উত্থান-পতন হয়েছে, তাও কোম্পানিটির ইতিহাসে সেরা। এর আগে কোম্পানিটির শেয়ার দরে এমন আকাশ-পাতাল উত্থান-পতন দেখা যায়নি। আজ কোম্পানিটির শেয়ার প্রথমভাগে ৫৩৮ টাকা ৯০ পয়সায় স্পর্শ করে লেনদেন হয়। পরে সেল প্রেসারে ৪৯৫ টাকা ১০ পয়সায় নেমে যায়। সার্কিট ব্রেকার না থাকায় আজ কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেনে ১৪৩ টাকা পার্থক্য দেখা যায়। যা অবশ্যই অস্বাভাবিক। দিনশেষে শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইস হয়েছে ৫০৯ টাকা ২০ পয়সায়।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটির শেয়ারের দরের সঙ্গে চমকপ্রদ ডিভিডেন্ডের পরিকল্পিত যোগসাজস রয়েছে। যে কারণে ডিভিডেন্ডের চমক থাকার পরও আকাশে উঠা শেয়ারটি ধপাস করে মাটিতে পড়েছে। যেসব বিনিয়োগকারী লোভে পড়ে শেয়ারটি চড়া দরে কিনেছেন, তারা ভালোভাবেই ধরা খেয়েছেন- এটা এখন নিশ্চিত বলা যায়। কোম্পানিটির শেয়ার কোনো বিবেচনায়ই এমন আকাশচুম্বী দর হতে পারে না।

তাদের মতে, স্বল্পমূলধনী এ কোম্পানিটি এমনিতেই পূঞ্জীভুত লোকসানে রয়েছে। এছাড়া সর্বশেষ ৯ মাসের হিসেবেও যার ইপিএস ছিল ৫ টাকা ১৬ পয়সা, হঠাৎ করে কি এমন হলো যে শেষের তিন মাসে কোম্পানিটির ইপিএস ৭ টাকারও বেশি বেড়ে গেল! এছাড়া ৪০ শতাংশ ডিভিডেন্ডের মধ্যে ৩০ শতাংশই স্টক ডিভিডেন্ড। কাজেই কোম্পানিটি স্টক ডিভিডেন্ডের নামে বিনিয়োগকারীদের কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখার দাবি জানান তারা।

তারা আরও বলছেন, দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানিই সমাপ্ত বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য স্টক ডিভিডেন্ড প্রদান করে। এতে শেয়ার সংখ্যা বাড়লেও থিওরিটিক্যাল অ্যাডজাস্টমেন্টের কারণে শেয়ার দর কমে যায়। পরিণতিতে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের মুনাফার হাড়ি বোঝাই হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। কারণ হিসেবে তারা বলেন, আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা স্বল্প সময়ে মুনাফা লাভের উদ্দেশে বিনিয়োগ করে থাকেন।

ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, কোম্পানির চলতি ২০২১-২২ হিসাব বছরের আয়ে এক ভুতুড়ে হিসাব দেখা যায়। কোম্পানি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ার প্রতি ৫ টাকার বেশি আয় করলেও তৃতীয় প্রান্তিকে আয় করেছে মাত্র ৪ পয়সা। এদিকে ৯ মাসের ব্যবধানে এনএভি বেড়েছে ৫১৯ শতাংশের বেশি। কোম্পানিটির আয়ে এবং আর্থিক প্রতিবেদন এমন গরমিলে হিসাবকে ‘ভুতুড়ে’ হিসাব বলছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, ২০২০-২১ হিসাব বছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) ছিল ৭২ পয়সা এবং শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ৯৩ পয়সা। কিন্তু ২০২১-২২ হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে এসে কোম্পানটি ইপিএস দেখায় ৫ টাকা ১২ পয়সা, এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে ১ টাকা ৫৬ পয়সা ও পরের তিন মাসে ৩ টাকা ৫১ পয়সা ছিল। কিন্তু পরের তিন মাসে এসে কোম্পানিটি ইপিএস দেখায় ৪ পয়সা। তবে ৯ মাসের ব্যবধানে আবার এনএভি ৫১৯ শতাংশের বেশি হিসাবে দেখানো হয়েছে ৫ টাকা ৭৬ পয়সা।

সর্বশেষ আজ কোম্পানিটির বোর্ড সভায় কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১২ টাকা ৪৯ পয়সা এবং শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) ৩০ টাকা ০১ পয়সা ঘোষণা করা হয়েছে। যা পুরোটাই সন্দেহজনক। এমন শেয়ার কারসাজির যোগসাজশ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন: জেমিনি সি ফুডের ডিভিডেন্ড ঘোষণা

অপরদিকে কোম্পানিটির বিগত আর্থিক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৯ টাকা ৮৩ পয়সা। এর আগের ২০১৮ ও ২০১৯ হিসাব বছরে যথাক্রমে ইপিএস হয়েছে মাত্র ৭০ ও ৩৭ পয়সা। আর ২০২০ সালে এনএভি ছিল মাত্র ২১ পয়সা।

প্রসঙ্গত, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে কোম্পানিটির কাছে এ বছরের ৬ সেপ্টেম্বর শেয়ার দর ও লেনদেন বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চায়। তখন কোম্পানি অস্বাভাবিক শেয়ার দর ও লেনদেন বৃদ্ধির পেছনে অপ্রকাশিত কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে ডিএসইকে জানায়।

ঢাকা/এইচকে