১১:২৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

দম নিন: সুস্থ্য থাকুন

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৪:২৩:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ মে ২০২১
  • / ৪১৯৭ বার দেখা হয়েছে

শক্তির প্রধান উৎস অক্সিজেন। অক্সিজেন দেহের প্রতিটি কোষে পৌঁছে রক্তের মাধ্যমে। একজন পূর্ণ বয়স্কের শরীরে গড়ে রক্তের পরিমাণ আড়াই থেকে তিন লিটার। এক হাজার পৃথক পৃথক রুটে এই রক্ত প্রবাহিত হয়ে শরীরের ৭৫ ট্রিলিয়ন সেল বা দেহকোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কোষে সঞ্চিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে এসে ফুসফুসে ছেড়ে দেয়। আবার ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে রক্ত ছুটে চলে দেহকোষে। এভাবেই দেহকোষের খাবার অক্সিজেন পৌঁছছে প্রতিনিয়ত। যখন আমরা কাজকর্ম ছাড়া চুপচাপ বসে থাকি তখন এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি কোষে গড়ে সাধারণত মিনিটে একবার করে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন পৌঁছে। আর যখন আমরা কাজ করি তখন দৈহিক পরিশ্রম ভেদে প্রতিটি কোষে মিনিটে ৩ থেকে ৬ বার রক্ত চলাচল করে। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের হার্ট প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার লিটার রক্ত পাম্প করে। আর এই রক্তকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ করে আমাদের ফুসফুস।

ফুসফুস আমাদের শরীরের বিশেষ ধরনের অঙ্গ। বুকের পাঁজরের নিচেই এর অবস্থান। এটি হচ্ছে স্থিতিস্থাপকতা (ইলাস্টিসিটি) গুণসম্পন্ন অনেকগুলো ছোট ছোট থলির সমন্বয়ে বড় দুটো থলির মতো। এর নিজস্ব কোনো পেশী নেই। তাই নিজে নিজে ফুলতে বা সঙ্কুচিত হতে পারে না। আমরা বুক ফোলালে তা ফুলে ওঠে। আর পরিপূর্ণভাবে ফোলালে মোটামুটি একটা বাস্কেট বলের সমপরিমাণ বাতাস ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ আমরা বুকের পেশী যত ফোলাতে শিখব ফুসফুসের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ ততই বাড়বে, সেই সাথে বেশি পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে দিতে সক্ষম হবো।

আমরা জানি, অক্সিজেন আমাদের শক্তি, অক্সিজেন আমাদের প্রাণ। কিন্তু ঠিকভাবে দম নিতে না পারার কারণে শতকরা নব্বইজনের মধ্যে আলস্য ও নির্জীবতা দেখা দেয়। প্রাণপ্রাচুর্যের অভাব তৈরি হয়। ম্যাসাচুসেটসের চেস্ট স্পেশালিস্ট ড. রুডি ট্যাডারহিল দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন যে, ‘সঠিক দম নেয়া ও ছাড়ার পদ্ধতি সবাই সহজভাবে অর্জন করে না। এটা চর্চা করে অর্জন করতে হয়। ঠিকভাবে দম না নেয়ার কারণে অবসাদ, ক্লান্তি, ব্রংকাইটিস, এজমা, সর্দি, নার্ভাস ব্রেকডাউন প্রভৃতি ঘটতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘শতকরা নব্বই জনই সঠিকভাবে দম নিতে পারেন না।’ তার মতে, নাক দিয়ে নিয়মিত দম নেয়ার অভ্যাস করতে পারলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া আমাদের প্রায়ই গভীর দম নেয়া উচিত। তাহলে আমরা ফুসফুসের তলানিতে আবদ্ধ বাতাস ও বাষ্প পরিষ্কার করতে সক্ষম হবো।

সঠিকভাবে দম নেয়ার গুরুত্ব পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা অনেক পরে অনুধাবন করলেও প্রাচ্যের জ্ঞানীরা দম নিয়ন্ত্রণ বা প্রাণায়াম করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিসরের এই দম নিয়ন্ত্রণ বা প্রাণায়াম চর্চা হয়ে আসছে কম করে হলেও পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই। অবশ্য এ চর্চা সীমিত ছিল প্রধানত সাধু, সন্ত ও দরবেশদের মাঝে। কারণ তারা জানতেন দমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে দেহ ও মনের ওপরও আসবে স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ।

দম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ালে প্রতিটি দেহকোষ বা সেল পর্যাপ্ত পুষ্টি পেয়ে শক্তিশালী হবে। শরীর ও মস্তিষ্ক পূর্ণ ক্ষমতা ও দক্ষতায় কাজ করতে সক্ষম হবে। আপনার ত্বক, চুল, চোখ ও চেহারায় সৃষ্টি হবে নতুন ঔজ্জ্বল্য ও আভা। আপনি হয়ে উঠবেন আত্মবিশ্বাসী ও প্রাণবন্ত।

দম নেয়ার ক্ষেত্রে শতকরা নব্বই জনেরই প্রধান ত্রুটি হচ্ছে তারা বুক ফুলিয়ে দম নেন না। দম নেয়ার সময় এদের যা ফোলে তা হচ্ছে পেট। দমের সাথে প্রতিনিয়ত পেট ওঠানামা করায় এদের পেটের পেশী অল্প বয়সেই শিথিল হয়ে যায় এবং পেটে একটা ঢলঢলে ভাব চলে আসে। আর বুক তেমন না ফোলানোর ফলে পর্যাপ্ত বাতাসও ফুসফুসে প্রবেশ করার সুযোগ পায় না। ফলে এদের দেহকোষ সবসময়ই পর্যাপ্ত অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত থাকে। উজ্জীবন প্রণালীতে দম নেয়ার চর্চা নিয়মিত করলেই এই অভ্যাস পরিবর্তিত হয়ে বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে।

প্রথমে আপনি কোনো আসনে বা চেয়ারে আরাম করে বসুন। চোখ বন্ধ করুন। মেরুদণ্ড রাখুন টান টান সোজা। কল্পনা করুন নাকের সামনে বাতাসভর্তি একটা পেয়ালা রয়েছে। পেয়ালার পুরো বাতাসই দমের সাথে ফুসফুসে পাঠাতে হবে। কিন্তু একবার নয়, চারবারে।

এখন কল্পনায় বায়ুভর্তি পেয়ালাকে চার ভাগ করুন। এবার পাত্র থেকে দম নেয়া শুরু করুন। ‘হু…’ করে নাক দিয়ে চার ভাগের প্রথম ভাগ বাতাস নিন। বুক একটু ফোলান। মুহূর্তমাত্র বিরতি দিয়ে ‘হু……..’ করে নাক দিয়ে দ্বিতীয় ভাগ বাতাস টেনে নিন। বুক আরো একটু ফুলবে। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে ‘হু…’ করে বাতাসের তৃতীয় ভাগ টেনে নিন। বুক আরেকটু ফুলবে। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে ‘হু…’ করে পেয়ালার বাতাসের শেষ ভাগ টেনে নিন। এখন আপনার বুক পুরোপুরি ফুলে উঠবে।

এবার যতটুকু বাতাস নাক দিয়ে টেনে নিয়েছেন তা মুখ দিয়ে ছাড়তে শুরু করবেন। ছাড়বেনও ঠিক আগের প্রক্রিয়ায় চারবারে। প্রথমে ‘ফু….’ করে এক চতুর্থাংশ ছাড়ুন। বুক পুরোপুরি ফোলানোর পর যে অবস্থা হয়েছিল তা থেকে কমবে চার ভাগের একভাগ। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার ‘ফু…’ করে বুক থেকে দ্বিতীয় ভাগ বাতাস বের করে দিন। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার ‘ফু…’ করে তৃতীয় ভাগ বাতাস বের করে দিন। বুকের স্ফীতি আরো হ্রাস পাবে। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার ‘ফু…’ করে মুখ দিয়ে ফুসফুস থেকে শেষ বাতাসটুকু বের করে দিন। বুকের স্ফীতি কমে তা দাঁড়াবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

দম নেয়ার এ প্রণালীটি পড়তে গিয়ে আপনার মনে হবে বেশ জটিল লাগছে। কিন্তু বাস্তবে করতে গিয়ে দেখবেন অনেক সোজা। সোজা লাগার সাথে সাথে মজাও পাবেন প্রচুর। এককথায় যে পরিমাণ বাতাস আপনার ফুসফুস গ্রহণ করতে পারে তা একবারে না নিয়ে মুহূর্ত মুহূর্ত বিরতি দিয়ে চার বারে নেবেন এবং মুহূর্ত মুহূর্ত বিরতি দিয়ে চার বারে তা ছাড়বেন। নেবেন নাক দিয়ে, ছাড়বেন মুখ দিয়ে। আর এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে আপনার লাগবে কয়েক সেকেন্ড মাত্র।

এভাবে আপনি প্রতিদিন ১০ মিনিট করে দম নেয়া ও ছাড়ার অভ্যাস করুন। ধীরে ধীরে কয়েক মাসের মধ্যেই অবচেতনভাবে বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং দম নেয়ার ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণ-প্রাচুর্যে উজ্জীবিত হয়ে উঠবেন। যারা একটু অলস প্রকৃতির তারা সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর বিছানায় শুয়ে শুয়েও এভাবে দম নেয়ার অভ্যাস করতে পারেন। তাতেও একই ফলাফল পাবেন।

দম নিয়ন্ত্রণের কতগুলো সহজ পদ্ধতি রয়েছে যা চর্চা করলে আপনি নিঃসন্দেহে শারীরিক ও মানসিকভাবে উপকৃত হবেন।

১. চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাত দুটো শরীরের দুপাশে রাখুন। হাতের মুঠো বন্ধ করে ধীরে ধীরে দম নিতে নিতে হাত উপরের দিকে উঠিয়ে মাথার পিছনে নিয়ে রাখুন। আবার ছাড়তে ছাড়তে হাত দুটো আগের মতো শরীরের দুপাশে রাখুন। এভাবে ২০ বার করুন।

২. যে-কোনো আসনে বা চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন। দুই নাসিকা দিয়ে ধীরে ধীরে বুক ভরে দম নিন। দম নেয়ার পর ধীরে ধীরে দুই নাসিকা দিয়েই দম ছাড়ুন। যতক্ষণে দম নেবেন তার চেয়ে কিছু বেশি সময় নিয়ে দম ছাড়ুন। দম নেবেনও দুই নাসিকায়। ছাড়বেনও দুই নাসিকায়। ১০ বার এভাবে দম নেন।

৩. কোনো আসনে বা চেয়ারে সোজা হয়ে বসুন। তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা আঙ্গুল ভাঁজ করে হাতের তালুতে রাখুন। এবার বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ডান নাসিকা বন্ধ করে বাম নাসিকা দিয়ে ধীরে ধীরে দম নিন। দম নেয়া শেষ হলে ছোট আঙ্গুল দিয়ে বাম নাসিকা বন্ধ করে ডান নাসিকা দিয়ে দম ছাড়ুন। দম ছাড়া শেষ হলে ডান নাসিকা দিয়ে ধীরে ধীরে দম নিন। দম নেয়া শেষ হলে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ডান নাসিকা বন্ধ করে বাম নাসিকা দিয়ে ধীরে ধীরে দম ছাড়ুন। বাম নাসিকায় দম নিয়ে ডান নাসিকা দিয়ে ছাড়ার পর এবং ডান নাসিকায় দম নিয়ে বাম নাসিকা দিয়ে ছাড়লে এক প্রস্থ দম নেয়া হয়। এভাবে ১০ বার দম নিন।

৪. হাঁটতে হাঁটতেও দম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন আপনি। যারা সকালে বা বিকেলে হাঁটেন তাদের হাঁটায় দম নিয়ন্ত্রণ একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। প্রথম অবস্থায় দম নিতে নিতে ৬ কদম হাঁটুন। আর দম ছাড়তে ছাড়তে ৮ কদম। ক্রমান্বয়ে কদমের পরিমাণ বাড়াতে পারেন। অর্থাৎ দম নিতে নিতে ৮ কদম, ছাড়তে ছাড়তে ১২ কদম। আরো পরে দম নিতে নিতে ১০ কদম, ছাড়তে ছাড়তে ১৬ কদম। এতে আপনি হাঁটার উপকারের সাথে সাথে পাবেন দম নিয়ন্ত্রণের উপকার।

ঢাকা/এসএ

শেয়ার করুন

x
English Version

দম নিন: সুস্থ্য থাকুন

আপডেট: ০৪:২৩:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ মে ২০২১

শক্তির প্রধান উৎস অক্সিজেন। অক্সিজেন দেহের প্রতিটি কোষে পৌঁছে রক্তের মাধ্যমে। একজন পূর্ণ বয়স্কের শরীরে গড়ে রক্তের পরিমাণ আড়াই থেকে তিন লিটার। এক হাজার পৃথক পৃথক রুটে এই রক্ত প্রবাহিত হয়ে শরীরের ৭৫ ট্রিলিয়ন সেল বা দেহকোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কোষে সঞ্চিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে এসে ফুসফুসে ছেড়ে দেয়। আবার ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে রক্ত ছুটে চলে দেহকোষে। এভাবেই দেহকোষের খাবার অক্সিজেন পৌঁছছে প্রতিনিয়ত। যখন আমরা কাজকর্ম ছাড়া চুপচাপ বসে থাকি তখন এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি কোষে গড়ে সাধারণত মিনিটে একবার করে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন পৌঁছে। আর যখন আমরা কাজ করি তখন দৈহিক পরিশ্রম ভেদে প্রতিটি কোষে মিনিটে ৩ থেকে ৬ বার রক্ত চলাচল করে। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের হার্ট প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার লিটার রক্ত পাম্প করে। আর এই রক্তকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ করে আমাদের ফুসফুস।

ফুসফুস আমাদের শরীরের বিশেষ ধরনের অঙ্গ। বুকের পাঁজরের নিচেই এর অবস্থান। এটি হচ্ছে স্থিতিস্থাপকতা (ইলাস্টিসিটি) গুণসম্পন্ন অনেকগুলো ছোট ছোট থলির সমন্বয়ে বড় দুটো থলির মতো। এর নিজস্ব কোনো পেশী নেই। তাই নিজে নিজে ফুলতে বা সঙ্কুচিত হতে পারে না। আমরা বুক ফোলালে তা ফুলে ওঠে। আর পরিপূর্ণভাবে ফোলালে মোটামুটি একটা বাস্কেট বলের সমপরিমাণ বাতাস ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ আমরা বুকের পেশী যত ফোলাতে শিখব ফুসফুসের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ ততই বাড়বে, সেই সাথে বেশি পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে দিতে সক্ষম হবো।

আমরা জানি, অক্সিজেন আমাদের শক্তি, অক্সিজেন আমাদের প্রাণ। কিন্তু ঠিকভাবে দম নিতে না পারার কারণে শতকরা নব্বইজনের মধ্যে আলস্য ও নির্জীবতা দেখা দেয়। প্রাণপ্রাচুর্যের অভাব তৈরি হয়। ম্যাসাচুসেটসের চেস্ট স্পেশালিস্ট ড. রুডি ট্যাডারহিল দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন যে, ‘সঠিক দম নেয়া ও ছাড়ার পদ্ধতি সবাই সহজভাবে অর্জন করে না। এটা চর্চা করে অর্জন করতে হয়। ঠিকভাবে দম না নেয়ার কারণে অবসাদ, ক্লান্তি, ব্রংকাইটিস, এজমা, সর্দি, নার্ভাস ব্রেকডাউন প্রভৃতি ঘটতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘শতকরা নব্বই জনই সঠিকভাবে দম নিতে পারেন না।’ তার মতে, নাক দিয়ে নিয়মিত দম নেয়ার অভ্যাস করতে পারলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া আমাদের প্রায়ই গভীর দম নেয়া উচিত। তাহলে আমরা ফুসফুসের তলানিতে আবদ্ধ বাতাস ও বাষ্প পরিষ্কার করতে সক্ষম হবো।

সঠিকভাবে দম নেয়ার গুরুত্ব পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা অনেক পরে অনুধাবন করলেও প্রাচ্যের জ্ঞানীরা দম নিয়ন্ত্রণ বা প্রাণায়াম করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিসরের এই দম নিয়ন্ত্রণ বা প্রাণায়াম চর্চা হয়ে আসছে কম করে হলেও পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই। অবশ্য এ চর্চা সীমিত ছিল প্রধানত সাধু, সন্ত ও দরবেশদের মাঝে। কারণ তারা জানতেন দমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে দেহ ও মনের ওপরও আসবে স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ।

দম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ালে প্রতিটি দেহকোষ বা সেল পর্যাপ্ত পুষ্টি পেয়ে শক্তিশালী হবে। শরীর ও মস্তিষ্ক পূর্ণ ক্ষমতা ও দক্ষতায় কাজ করতে সক্ষম হবে। আপনার ত্বক, চুল, চোখ ও চেহারায় সৃষ্টি হবে নতুন ঔজ্জ্বল্য ও আভা। আপনি হয়ে উঠবেন আত্মবিশ্বাসী ও প্রাণবন্ত।

দম নেয়ার ক্ষেত্রে শতকরা নব্বই জনেরই প্রধান ত্রুটি হচ্ছে তারা বুক ফুলিয়ে দম নেন না। দম নেয়ার সময় এদের যা ফোলে তা হচ্ছে পেট। দমের সাথে প্রতিনিয়ত পেট ওঠানামা করায় এদের পেটের পেশী অল্প বয়সেই শিথিল হয়ে যায় এবং পেটে একটা ঢলঢলে ভাব চলে আসে। আর বুক তেমন না ফোলানোর ফলে পর্যাপ্ত বাতাসও ফুসফুসে প্রবেশ করার সুযোগ পায় না। ফলে এদের দেহকোষ সবসময়ই পর্যাপ্ত অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত থাকে। উজ্জীবন প্রণালীতে দম নেয়ার চর্চা নিয়মিত করলেই এই অভ্যাস পরিবর্তিত হয়ে বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে।

প্রথমে আপনি কোনো আসনে বা চেয়ারে আরাম করে বসুন। চোখ বন্ধ করুন। মেরুদণ্ড রাখুন টান টান সোজা। কল্পনা করুন নাকের সামনে বাতাসভর্তি একটা পেয়ালা রয়েছে। পেয়ালার পুরো বাতাসই দমের সাথে ফুসফুসে পাঠাতে হবে। কিন্তু একবার নয়, চারবারে।

এখন কল্পনায় বায়ুভর্তি পেয়ালাকে চার ভাগ করুন। এবার পাত্র থেকে দম নেয়া শুরু করুন। ‘হু…’ করে নাক দিয়ে চার ভাগের প্রথম ভাগ বাতাস নিন। বুক একটু ফোলান। মুহূর্তমাত্র বিরতি দিয়ে ‘হু……..’ করে নাক দিয়ে দ্বিতীয় ভাগ বাতাস টেনে নিন। বুক আরো একটু ফুলবে। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে ‘হু…’ করে বাতাসের তৃতীয় ভাগ টেনে নিন। বুক আরেকটু ফুলবে। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে ‘হু…’ করে পেয়ালার বাতাসের শেষ ভাগ টেনে নিন। এখন আপনার বুক পুরোপুরি ফুলে উঠবে।

এবার যতটুকু বাতাস নাক দিয়ে টেনে নিয়েছেন তা মুখ দিয়ে ছাড়তে শুরু করবেন। ছাড়বেনও ঠিক আগের প্রক্রিয়ায় চারবারে। প্রথমে ‘ফু….’ করে এক চতুর্থাংশ ছাড়ুন। বুক পুরোপুরি ফোলানোর পর যে অবস্থা হয়েছিল তা থেকে কমবে চার ভাগের একভাগ। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার ‘ফু…’ করে বুক থেকে দ্বিতীয় ভাগ বাতাস বের করে দিন। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার ‘ফু…’ করে তৃতীয় ভাগ বাতাস বের করে দিন। বুকের স্ফীতি আরো হ্রাস পাবে। মুহূর্ত বিরতি দিয়ে আবার ‘ফু…’ করে মুখ দিয়ে ফুসফুস থেকে শেষ বাতাসটুকু বের করে দিন। বুকের স্ফীতি কমে তা দাঁড়াবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

দম নেয়ার এ প্রণালীটি পড়তে গিয়ে আপনার মনে হবে বেশ জটিল লাগছে। কিন্তু বাস্তবে করতে গিয়ে দেখবেন অনেক সোজা। সোজা লাগার সাথে সাথে মজাও পাবেন প্রচুর। এককথায় যে পরিমাণ বাতাস আপনার ফুসফুস গ্রহণ করতে পারে তা একবারে না নিয়ে মুহূর্ত মুহূর্ত বিরতি দিয়ে চার বারে নেবেন এবং মুহূর্ত মুহূর্ত বিরতি দিয়ে চার বারে তা ছাড়বেন। নেবেন নাক দিয়ে, ছাড়বেন মুখ দিয়ে। আর এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে আপনার লাগবে কয়েক সেকেন্ড মাত্র।

এভাবে আপনি প্রতিদিন ১০ মিনিট করে দম নেয়া ও ছাড়ার অভ্যাস করুন। ধীরে ধীরে কয়েক মাসের মধ্যেই অবচেতনভাবে বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং দম নেয়ার ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণ-প্রাচুর্যে উজ্জীবিত হয়ে উঠবেন। যারা একটু অলস প্রকৃতির তারা সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর বিছানায় শুয়ে শুয়েও এভাবে দম নেয়ার অভ্যাস করতে পারেন। তাতেও একই ফলাফল পাবেন।

দম নিয়ন্ত্রণের কতগুলো সহজ পদ্ধতি রয়েছে যা চর্চা করলে আপনি নিঃসন্দেহে শারীরিক ও মানসিকভাবে উপকৃত হবেন।

১. চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাত দুটো শরীরের দুপাশে রাখুন। হাতের মুঠো বন্ধ করে ধীরে ধীরে দম নিতে নিতে হাত উপরের দিকে উঠিয়ে মাথার পিছনে নিয়ে রাখুন। আবার ছাড়তে ছাড়তে হাত দুটো আগের মতো শরীরের দুপাশে রাখুন। এভাবে ২০ বার করুন।

২. যে-কোনো আসনে বা চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন। দুই নাসিকা দিয়ে ধীরে ধীরে বুক ভরে দম নিন। দম নেয়ার পর ধীরে ধীরে দুই নাসিকা দিয়েই দম ছাড়ুন। যতক্ষণে দম নেবেন তার চেয়ে কিছু বেশি সময় নিয়ে দম ছাড়ুন। দম নেবেনও দুই নাসিকায়। ছাড়বেনও দুই নাসিকায়। ১০ বার এভাবে দম নেন।

৩. কোনো আসনে বা চেয়ারে সোজা হয়ে বসুন। তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা আঙ্গুল ভাঁজ করে হাতের তালুতে রাখুন। এবার বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ডান নাসিকা বন্ধ করে বাম নাসিকা দিয়ে ধীরে ধীরে দম নিন। দম নেয়া শেষ হলে ছোট আঙ্গুল দিয়ে বাম নাসিকা বন্ধ করে ডান নাসিকা দিয়ে দম ছাড়ুন। দম ছাড়া শেষ হলে ডান নাসিকা দিয়ে ধীরে ধীরে দম নিন। দম নেয়া শেষ হলে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ডান নাসিকা বন্ধ করে বাম নাসিকা দিয়ে ধীরে ধীরে দম ছাড়ুন। বাম নাসিকায় দম নিয়ে ডান নাসিকা দিয়ে ছাড়ার পর এবং ডান নাসিকায় দম নিয়ে বাম নাসিকা দিয়ে ছাড়লে এক প্রস্থ দম নেয়া হয়। এভাবে ১০ বার দম নিন।

৪. হাঁটতে হাঁটতেও দম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন আপনি। যারা সকালে বা বিকেলে হাঁটেন তাদের হাঁটায় দম নিয়ন্ত্রণ একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। প্রথম অবস্থায় দম নিতে নিতে ৬ কদম হাঁটুন। আর দম ছাড়তে ছাড়তে ৮ কদম। ক্রমান্বয়ে কদমের পরিমাণ বাড়াতে পারেন। অর্থাৎ দম নিতে নিতে ৮ কদম, ছাড়তে ছাড়তে ১২ কদম। আরো পরে দম নিতে নিতে ১০ কদম, ছাড়তে ছাড়তে ১৬ কদম। এতে আপনি হাঁটার উপকারের সাথে সাথে পাবেন দম নিয়ন্ত্রণের উপকার।

ঢাকা/এসএ